শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: টানা দরপতনের কবলে দেশের পুঁজিবাজার। ডিএসইর লেনদেন প্রায় ২০ কার্যদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থান করছে। ফলে পুঁজিবাজার নিয়ে গভীর সংকটে পড়ছে বিনিয়োগকারীরা। এ থেকে উত্তরনের উপায় কি? কেউ বলতে পারছেন না। তেমনি মুখ খুলতে পারছেন না নীতি নির্ধারকরা। শুধুই আশার বানী।

এ অবস্থার মধ্যেও টানা দরপতনে প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বেড়েই চলছে বিনিয়োগকারীদের হাহাকার। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পুঁজি হারা বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ করা পুঁজি রক্ষায় কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।

এতে নীরবে তাদের রক্তক্ষরণ বেড়েই চলছে। পতনের ধাক্কায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। অনেকে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। সংসার জীবনেও অশান্তি দেখা দিয়েছে কারও কারও। বিশেষ করে মার্জিন লোনের বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হচ্ছে। মুলত পুঁজি হারিয়ে দিন দিন লোনের পরিমান বাড়ছে।

অথচ পুঁজিবাজারের এ পতন ঠেকাতে প্রায় এক বছর ধরে চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পুঁজি হারা বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ আর সংশ্লিষ্টদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুঁজিবাজারের জন্য নেয়া হয় একগুচ্ছ পদক্ষেপ। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই বাজারের পতন ঠেকাতে পারছে না। যে কারণে অনেক বিনিয়োগকারীর কাছে এখন পুঁজিবাজার আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

এদিকে দেশের পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয় গত ২৮ জুলাই। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষার্থে দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। কিন্তু দীর্ঘদিন এই সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকার কারণে নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

তাছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্যের পরীক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সূচক পতনের সঙ্গে আগের কর্মদিবসের মতো লেনদেন তিন শ কোটির ঘর অতিক্রম করতে পারল না। সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এ নিয়ে গত ১১ কর্মদিবসের মধ্যে ৬ দিনই লেনদেন হলো তিন শ কোটির ঘরে। বাকি চার দিন চার শ কোটি ও এক কর্মদিবস লেনদেন হয়েছে পাঁচ শ কোটির বেশি।

লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির জন্য বসিয়ে ক্রেতা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এই অবস্থা থেকে কবে উত্তরণ হবে, তার কোনো আভাস না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। বহু বিনিয়োগকারী এখন ব্রোকারেজ হাউজে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতিতে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাতে বাগড়া বসিয়েছে। যুদ্ধের অভিঘাতে অস্বস্তিতে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতির এ নেতিবাচক প্রভাব থেকে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে শেয়ারের দামে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এটি বিনিয়োগকারীদের পুঁজির কিছুটা সুরক্ষা দিলেও কমে যায় লেনদেন।

বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে বেশ কিছু শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। এসব শেয়ারে যারা মুনাফা তুলেছেন, তারা এখন অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও নিষ্কিয়। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল থাকলেও এদের অনেকেই এখন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।

একাধিক ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ট্রেডাররা বলছেন, তাদের বড় গ্রাহকদের অনেকেই ফ্লোর প্রাইসে শেয়ার কিনতে চাচ্ছেন না। তাদের ধারণা, যেকোনো সময় ফ্লোর প্রাইস উঠে গেলে এর চেয়ে কম দামে শেয়ার পাওয়া সম্ভব। সে জন্য তারা অপেক্ষা করতে চান। আবার আগামী বছর নির্বাচন। রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করছে বিরোধীরা। প্রতিহতের হুমকি সরকারের।

সব মিলিয়ে আগামীতে রাজনীতি-অর্থনীতির গতিপথ কোন দিকে যায়, সেটি বুঝতেও অনেকে অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাজার কারসাজির দায়ে সহযোগীসহ একজন বড় বিনিয়োগকারীকে দফায় দফায় জরিমানা করায় তিনি ও তার অনুসারীরা নিষ্কিয় রয়েছেন এমন কথাও শোনা যায় হরহামেশা। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ঘূর্ণাবর্তে আটকে গেছে পুঁজিবাজার।

এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সম্প্রতি ডিএসই ও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, বাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ঐই দিন ডিএসই থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ খবর জানানোর পরও তা বিনিয়োগকারীদের আশাবাদী করতে পারেনি।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কাজী হোসাইন আলী বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার মধ্যে অনেক দেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও আমাদের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। টানা দরপতনের ফলে বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় বড় বিনিয়োগকারীরা নিরব আচরন করছেন।

তিনি আরো বলেন, প্রশ্ন হলো যারা গত দুই বছর পুঁজিবাজার থেকে শ শ কোটি টাকা মুনাফা তুলছেন তারা এখন কোথায়। ৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজিবাজার এখন ৩ শত কোটি টাকা ঘরে নামলে বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আর কার্যকরী ভুমিকা নিতে হবে। যে কোন মুল্যে বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করতে হবে। তা না হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হয়ে যাবে।

স্টক অ্যান্ড বন্ডের বিনিয়োগকারী শেখ আজমন হোসেন বলেন, ৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজিবাজার এখন ৩ শত কোটির ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে এটা কোন সুস্থ বাজারের লক্ষণ নয়। লাখ লাখ বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে হলে বড় বিনিয়োগকারীসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দ্রুত বাজারমুখী করতে হবে।

অর্থনীতির চাপের কথা উঠে এসেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের কথায়ও। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর একটি দিনও পাইনি স্বাভাবিক। বিএসইসিতে যোগ দিয়েছি করোনার মধ্যে। দুই বছর করোনাভাইরাস। এরপর যুদ্ধ। এরপর আসছে নির্বাচনের বছর। সব সময় থাকলাম একটি ঝামেলার মধ্যে। কখনো সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ পাইনি।

যখন আমরা নরমালি কাজ করতে পারব। এটি আমাদের একটি বাধার মতো কাজ করেছে। সারাক্ষণ একটি অজানা বাধাতে থাকতে হয়েছে।’ তার আশা শিগগিরই এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। তখন ধীরে ধীরে বাজার স্বাভাবিক হতে থাকবে।

ফ্লোর প্রাইস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের পুঁজিবাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী ক্ষুদ্র। তাদের সুরক্ষা দিতেই ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছে। যত দিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে, তত দিন এটি থাকবে। কেননা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়ে বাজার ভালো করা যাবে না।