শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে অনিয়মে জড়িত থাকার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তি দেওয়া হয়নি। আবার সরাসরি অনিয়মে জড়িত না থেকেও কেউ কেউ পেয়েছেন বড় শাস্তি। ফলে অভিযোগ উঠেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়তা আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখাচ্ছে কঠোরতা।

ঠিক তেমনি লাভেলো আইসক্রিম, সি পার্ল ও বিবিএস ক্যাবলসসহ অন্যান্য কোম্পানিতে শেয়ার ধারণ না করেও ১০ কোটি টাকা জরিমানা ও ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হামদুল ইসলাম। এছাড়া, বানকো ফাইন্যান্সের মালিকানায় জড়িত না থেকেও কেবলমাত্র ওসব কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার দায়ে তার স্বজনদেরকে ১৬ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তবে, সম্প্রতি প্রত্যক্ষভাবে মালিকানায় সম্পৃক্ত থাকার পরও ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছে সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। একইভাবে বিডি থাই ফুডের শেয়ার ধারণ করা সত্বেও বিএলআই ক্যাপিটাল কোম্পানিটির ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে এই দুই ইস্যু ব্যবস্থাপককে জরিমানা করা হয়নি।

সিকিউরিটিজ আইনের ব্যত্যয়ের কারণে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দ্বিমুখী আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বানকো ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা কোম্পানিগুলোতে হামদুল ইসলামের আত্মীয়-স্বজন প্লেসমেন্ট শেয়ার ধারণ করায় ২০১৫ সালের পাবলিক ইস্যু রুলসের ৩(২)(ডি) লঙ্ঘন হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএসইসি। এ কারণে হামদুল ইসলাম ও তার পরিবারকে জরিমানা করেছে বিএসইসি। কিন্তু, কোনো ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানের এমডির আত্মীয়-স্বজন শেয়ার ব্যবসা করতে পারবে না, বিএসইসির ২০১৫ সালের আইনে এমন বিধান ছিল না।

২০১৫ সালের পাবলিক ইস্যু রুলসের ৩(২)(ডি)-তে বলা হয়েছে, ইস্যু ম্যানেজার ইস্যুয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না এবং শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই আইনটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ইস্যু ম্যানেজার ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি ইস্যুয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে না এবং শেয়ার ধারণ করতে পারবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইস্যু ম্যানেজারের সংজ্ঞায় সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার) বিধিমলিা ১৯৯৬ এর ২(ঞ) ধারায় বলা হয়েছে, মার্চেন্ট ব্যাংকার অর্থ এমন ব্যক্তি, যিনি এই বিধিমালার অধীন করপোরেট উপদেষ্টা, পোর্টফোলিও ম্যানেজার, অবলেখক এবং ইস্যু ব্যবস্থাপক হিসেবে যাবতীয় কাজ করার জন্য নিবন্ধন সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন। আর ব্যক্তি অর্থ কোম্পানি ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএসইসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইস্যু ম্যানেজার বানকো ফাইন্যান্স, যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মালিকরা। কিন্তু, বিএসইসি বানকো ফাইন্যান্সের ইস্যুয়ার কোম্পানির শেয়ার হামদুল ইসলামের স্বজনদের কেনার জন্য জরিমানা করেছে। এক্ষেত্রে ওই কোম্পানিগুলোর মধ্যে কোনটি থেকেই হামদুল ইসলাম শেয়ার কিনেননি।

অথচ, বিএসইসি সম্প্রতি ইস্যু ম্যানেজার সোনার বাংলা ক্যাপিটালের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সকে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে। সেক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয়ের কারণে জরিমানা করা হয়নি।

ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের খসড়া প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, এই কোম্পানিটি থেকে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সে বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের মালিকানা সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টেও আছে। এ বিবেচনায় মালিকানাধীন ইস্যু ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে শেয়ারবাজারে এসেছে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স।

সেক্ষেত্রে কোনো বাধা বা আইনগত সমস্যা হয়নি। বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি লেনদেন শুরু করা কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে বিএলআই ক্যাপিটাল, যার হোল্ডিং কোম্পানি বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। ওই প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি বা অধীনস্ত কোম্পানি বিএলআই ক্যাপিটাল।

এই বে-লিজিং, বিএলআই ক্যাপিটাল ও সাউথইস্ট ব্যাংকের কিছু পরিচালকের বিএলআই ক্যাপিটালে শেয়ার আছে। যারা আবার বিডি থাই ফুডেরও শেয়ার ধারণ করেছে। এর মধ্য দিয়েই শেয়ারবাজারে এসেছে বিডি থাই ফুড। বিডি থাই ফুডে আইপিও পূর্ব বা প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আছেন বিএলআই ক্যাপিটালের পরিচালক হূমায়ন কবির, সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির, সাউথইস্ট ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস। যাদের শেয়ার ৩ বছর লক-ইন থাকবে।

এই ৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিডি থাই ফুডের ১ লাখ শেয়ার ড. হূমায়ুন কবির, ২০ হাজার শেয়ার আলমগীর কবির, ৬২ লাখ শেয়ার সাউথইস্ট ব্যাংক ও ৩২ লাখ শেয়ার সাউথইস্ট ব্যাংক সার্ভিসেস ধারণ করে আসছে। তাদেরই নেতৃত্বাধীন বা সম্পৃক্ত বিএলআই ক্যাপিটাল ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে বিডি থাই ফুডের। আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের বড় শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। তিনি সম্প্রতি কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।

তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম বে-লিজিংয়ের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন, পরিচালক তারিক সুজাত ভাগনে আর পরিচালক জুবায়ের কবির তার ভাতিজা। স্বতন্ত্র পরিচালক জাইদি সাত্তার সাউথইস্ট ব্যাংক ফাউন্ডেশনের পরিচালক। আবার শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বে-লিজিংয়ের ইভিপি এম মনিরুজ জামান খান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক পদেও আছেন।

সাউথইস্ট ব্যাংক এবং এর মালিকানাধীন সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস বে-লিজিংয়ের শীর্ষ শেয়ারহোল্ডার। ২০১০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংক এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস বে-লিজিংয়ের প্রায় ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল। বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংকের মালিকানায় আছে ১ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার ৪০৫টি শেয়ার, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসের মালিকানায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বে-লিজিংয়ের ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯টি শেয়ার ছিল। যা ছিল ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এখন আছে মাত্র ৩০ লাখ শেয়ার।

গত জানুয়ারিতে মার্চেন্ট ব্যাংকটি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬১ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করে। এছাড়া, সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির তার ব্যক্তিগত বিও হিসাবে থাকা বে লিজিংয়ের প্রায় ৪০ লাখ শেয়ারের পুরোটাই বিক্রি করেন। এসব শেয়ার তিনি এক যুগেরও বেশি সময় রেখেছিলেন।

এ বিষয়ে আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শেয়ারবাজারে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সকে আনার জন্য ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছে সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। একইভাবে বিডি থাই ফুডের ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছে বিএলআই ক্যাপিটাল। দুই ইস্যু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার ধারণ করলেও তাদেরকে কোনো জরিমানা করা হয়নি।

কিন্তু, একই অভিযোগে বানকো ফাইন্যান্সের এমডিসহ তার স্বজনদেরকে জরিমানা করা হয়েছে। এটি বিএসইসির দ্বিমুখী আচরণ।
বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হামদুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আমি ও আমার স্বজনরা আইন লঙ্ঘন করিনি। এ বিষয়ে বিএসইসির সঙ্গে কথা বলব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, ‘বানকো ফাইন্যান্সের এমডিকে জরিমানা করার বিষয়ে এখনো কোনো আদেশ জারি হয়নি। তাই, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা কমিশনারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’