শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশভাগের সময় কলকাতার বড় কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিল। সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে তাদের হতে গড়ে উঠেছিল পাটকল, বস্ত্রকলের বহু কারখানা। এ তালিকায় ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিরাও। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদের মতো পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছেন।

তবে নিজেদের পুরোনো আবাস কলকাতামুখী হয়নি মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি ও তাঁর সন্তান মির্জা মেহদী (সাদরি) ইস্পাহানি। কলকাতা থেকে এসে শুধু এ দেশে থেকে যাননি ইস্পাহানি পরিবারের এই দুই কিংবদন্তি। এ দেশের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রেখেছেন তাঁরা দুজন। সেই অবদানের তালিকা বড় হচ্ছে তাঁদের উত্তরসূরিদের হাত ধরে।

ইস্পাহানি পরিবারের পারিবারিক ব্যবসা ২০২ বছরের। সাত প্রজন্ম ধরে চলা এই ব্যবসার তিন প্রজন্মই এ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন। দেশভাগের সময় থেকে শুরু হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এম এম ইস্পাহানি লিমিটেডের ব্যবসার বয়স এখন ৭৫ বছর। ভারতীয় উপমহাদেশ বা পাকিস্তান আমল বাদ দিলেও বাংলাদেশের ৫০ বছরে অনেক খাতে পথ দেখিয়েছে এই গ্রুপ।

ইস্পাহানির ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের ব্যবসায়িক ঐতিহ্যও। বিশ্বে এমন গল্প খুব কমই আছে। বিশ্বজুড়ে ৬০টির মতো দেশে ২০০ বছরের বেশি পুরোনো ব্যবসায়িক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এখনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের সাতটি দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশে এই তালিকায় আছে শুধু ইস্পাহানি পরিবারই।

সপ্তম প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব: প্রায় ২০২ বছর ধরে সততা ও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসা এই প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়ায় অবদান ঈর্ষণীয়। ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে সমানতালে প্রসার করেছে নিজেদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের। ব্যবসায় নীতি-নৈতিকতার চর্চা ধরে রাখা গ্রুপটি মানুষের কল্যাণে সবকিছু করে নীরবে।

ব্যবসায়ী মহলেও ইস্পাহানি পরিবারকে সম্মানের আসনে রাখেন সবাই। ইস্পাহানি গ্রুপে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে সপ্তম প্রজন্ম। বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানি সপ্তম প্রজন্মের উত্তরসূরি। আলাপকালে বলেছেন ইস্পাহানির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।

ইসফাহান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে: ভারতীয় উপমহাদেশে এসে পারস্য বণিকদের বাণিজ্যের ইতিহাস অনেক পুরোনো। সেই বাণিজ্যের শেষ ধাপে ১৮২০ সালে পারস্যের (ইরান) ইসফাহান শহর থেকে ব্রিটিশশাসিত ভারতের মুম্বাই শহরে এসে ব্যবসা শুরু করেন হাজি মোহাম্মদ হাশিম। তাঁর হাত ধরেই ২০২ বছর আগে এ অঞ্চলে ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসার শুরু। সময়ের সঙ্গে ধাপে ধাপে মোহাম্মদ হাশিম ও তাঁর উত্তরসূরিরা লন্ডন, মিসর, রেঙ্গুন, ভারতের চেন্নাই ও কলকাতা ঘুরে ঢাকা এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন।

দেশভাগের আগে চা-পাটের ব্যবসা ছাড়াও বিমান পরিবহন, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিল গ্রুপটি। হাজি মোহাম্মদ হাশিমের উত্তরসূরিদের অনেকে পরে ব্যবসা বা চাকরি নিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত ও পাকিস্তানে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছেন। তবে কলকাতা থেকে আসা উত্তরসূরিরা ইস্পাহানির ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়ে চলেছেন এ দেশে।

পাট ও বস্ত্রে বড় বিনিয়োগ দিয়ে শুরু: পূর্ব পাকিস্তানে ইস্পাহানি গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরুর ইতিহাস লেখা আছে তৎকালীন যুক্তরাজ্যের মার্কেন্টাইল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের গোপনীয় নথিতে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছিল পূর্ব বাংলায়।

লিওনেল ব্ল্যাঙ্কস নামের সেই কর্মকর্তা মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হংকং ব্যাংকের নতুন শাখা খোলার সম্ভাবনা দেখতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম সফর করেন। সফর শেষে তাঁর দেওয়া প্রতিবেদনে তিনি তুলে ধরেন, কলকাতা থেকে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি বড় পরিসরে চট্টগ্রামে ব্যবসা সম্প্রসারণে যাচ্ছে। পাশাপাশি ইস্পাহানি পরিবার নিজেদের থাকার জন্য আসকারদীঘির পাড়ে ‘বিশপ হাউস’ কিনেছে। শহরের নানা জায়গায় তারা জমি কিনছে।

সাত প্রজন্ম: ইস্পাহানি পরিবার শুধু ব্যবসাই সম্প্রসারণ করেনি, দেশভাগের পর কলকাতা থেকে সদর দপ্তর চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশে ইস্পাহানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানির দাদা মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি। সে সময় চট্টগ্রামে একের পর এক কারখানা গড়ে ওঠে তাঁর হাত ধরে।

মির্জা আহমেদ ইস্পাহানির সন্তান মির্জা মেহদী (সাদরি) ইস্পাহানিও বাবার সঙ্গে শিল্পকারখানা গড়ার কাজে নেতৃত্ব দেন। এরপরে যুক্ত হন মির্জা মেহদী ইস্পাহানির সন্তান মির্জা আলী বেহরুজ ইস্পাহানি। ২০১৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর হাল ধরেন মির্জা মেহদী ইস্পাহানির আরেক সন্তান বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানি। উত্তরসূরিদের প্রত্যেকের হাতে ধরে ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে।

দেশভাগের পর কলকাতার ভিক্টরি জুট মিলের যন্ত্রপাতি খুলে এনে চট্টগ্রামের কাট্টলীতে একই নামে পাটকল স্থাপন করে ইস্পাহানি পরিবার। এরপর ১৯৫০ সালে কালুরঘাটে স্থাপন করা হয় চিটাগাং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৫৪ সালে পাহাড়তলীতে ‘পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিল’ নামে বস্ত্রকল গড়ে তোলে ইস্পাহানি।

চট্টগ্রামকে এগিয়ে নিতে একই সময়ে ইস্টার্ন ফেডারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানিটির সদর দপ্তর কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করেছিলেন এম এ ইস্পাহানি। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিপিং ব্যবসায়ও যুক্ত হয় গ্রুপটি। চট্টগ্রামে ইস্পাহানির প্রধান কার্যালয় স্থাপনের পরই খুব দ্রুত একের পর এক কারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বড় শিল্প গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পরিবারটি।

রুশ অর্থনীতিবিদ এস এস বারানভ ‘পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় পাটকল স্থাপনে যে কটি গ্রুপ ও পরিবার নেতৃত্ব দিয়েছিল, তার মধ্যে ইস্পাহানি পরিবার অন্যতম। দেশের শেয়ারবাজারের দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রতিষ্ঠার নেপথ্যেও ভূমিকা রয়েছে ইস্পাহানি পরিবারের।

ঢাকা চেম্বার প্রকাশিত ‘কমার্শিয়াল হিস্ট্রি অব ঢাকা’র তথ্য অনুসারে, ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানে উৎপাদনমুখী কারখানার সম্পদের বিচারে ইস্পাহানির অবস্থান ছিল ১২তম। তাদের উৎপাদনমুখী কারখানার সম্পদ ছিল ১৫৪ মিলিয়ন রুপি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার হিসাবে জহুরুল ইসলামের ইসলাম গ্রুপের পরে ইস্পাহানি ছিল দ্বিতীয়, যাদের প্রতিষ্ঠান ছিল ২৩টি।

বিপণন থেকে চায়ের উৎপাদন: ইস্পাহানি গ্রুপের শুরুর দিকের ব্যবসা ছিল চা। ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত চা রপ্তানি করলেও বাগান ছিল না ইস্পাহানির হাতে। দেশভাগের পর চট্টগ্রাম এসে বিপণনের পাশাপাশি এম এম ইস্পাহানি গ্রুপ প্রথম চা উৎপাদনে যুক্ত হয়। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ইস্পাহানি গ্রুপের হাত ধরেই ১৯৬০ সালে নেপচুন চা-বাগানের খাসজমিতে উৎপাদন শুরু হয়। এরপর সাত বছরের মাথায় একে একে মৌলভীবাজারের জেরিন চা-বাগান, গাজীপুর চা-বাগান এবং মির্জাপুর চা-বাগান ইস্পাহানি গ্রুপের হাতে আসে।

বাগান সম্প্রসারণের আরেকটি সুযোগ আসে তাঁদের হাতে। যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত সোয়ার গ্রুপ বিখ্যাত জেমস ফিনলে লিমিটেডকে অধিগ্রহণের পর এ দেশে প্রতিষ্ঠানটির বাগানের মালিকানা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালের মার্চে ইস্পাহানি ছাড়াও পাঁচটি গ্রুপ ও দুই ব্যক্তি ৩৯ হাজার ১১২ একরের বাগানের শেয়ার কিনে নেন। ফিনলে এখন চা উৎপাদনে শীর্ষে, যার অংশীদার ইস্পাহানিও।

ফিনলে ছাড়াও ২০২১ সালে ইস্পাহানির ৪টি বাগানে ৪৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। প্রায় ৭ হাজার ৮৮৫ একর আয়তনের ৪টি বাগানের উৎপাদন দিয়ে চতুর্থ অবস্থানে আছে কোম্পানিটি। একরপ্রতি উৎপাদনেও শীর্ষ তিন বাগানের একটি ইস্পাহানি। এ বছর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পরিবেশবান্ধব কারখানার পুরস্কার চালু করে। প্রথমবার চা-শিল্পে সেরা পরিবেশবান্ধব বাগান হিসেবে নির্বাচিত চারটি চা-বাগানের দুটিই ইস্পাহানির।

চা বিপণনের বাজারেও বহু বছর ধরে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে ইস্পাহানি। চায়ের বাজারে ইস্পাহানির আধিপত্য কেমন, তা একটু পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে। ২০১৯-২০ মৌসুমে দেশে ৯ কোটি ৫৫ লাখ কেজি চা বাজারজাত হয়েছে। এ চায়ের ১ কোটি ৮০ লাখ কেজিই বাজারজাত করে শীর্ষে অবস্থান করেছে ইস্পাহানি গ্রুপ। সহজভাবে বললে, দেশে প্রতি পাঁচ কাপ চায়ের এক কাপ তৈরি হয় ইস্পাহানির চা দিয়ে।

শুধু চায়ের কাপে ঝড় তোলেনি ইস্পাহানি, স্থানীয় ও বহুজাতিক ব্র্যান্ডকে ছাড়িয়ে বহু পুরস্কারও অর্জন করেছে ব্র্যান্ডটি। বাংলাদেশে ব্র্যান্ড ফোরাম সেরা ব্র্যান্ড পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকে প্রতিবছর চায়ের ব্র্যান্ডের মধ্যে প্রথম পুরস্কার পেয়ে আসছে গ্রুপটির ইস্পাহানি মির্জাপুর চা। বাংলাদেশে দেশীয় ও বহুজাতিক সব ব্র্যান্ডের মধ্যে ২০১৮ সালে প্রথম এবং ২০২১ সালে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে ইস্পাহানির চায়ের ব্র্যান্ড।

দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাহানি চায়ের রপ্তানি থেমে থাকেনি। লন্ডনের হ্যারডস স্টোরের তাকে উঠেছে মির্জাপুর ব্রেকফাস্ট টি, শ্রীমঙ্গল গ্রিন টি কিংবা ব্লেন্ডারস চয়েস ব্ল্যাক টি। এখনো ইস্পাহানি মির্জাপুর, ইসপি সুপার এবং স্টার অব বেঙ্গলসহ নানা নামে ইস্পাহানি চায়ের স্বাদ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দারা।

পথ দেখিয়েছে ব্যাংক-বিমা, এয়ারলাইনসে: ইস্পাহানি গ্রুপের হাত ধরে ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় ‘ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড’ নামে পূর্ব বাংলায় প্রথম বেসরকারি খাতের উড়োজাহাজ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকার কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে। আবার কলকাতায় মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি।

দেশভাগের আগে ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডারও ছিলেন তিনি। বেসরকারি খাতে উড়োজাহাজ ব্যবসায় অভিজ্ঞতা থাকার পরও কেন বিমান পরিবহন খাতে পরে আর যুক্ত হয়নি ইস্পাহানি গ্রুপ, এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা সালমান ইস্পাহানি বলেন, ‘দাদার (এম এ ইস্পাহানি) হাতে এই ব্যবসার সূচনা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে দাদার মৃত্যুর পর এই খাতে পরিবারের আর কেউ অভিজ্ঞ ছিল না। সে জন্য বিমান পরিবহন ব্যবসায় আর ফেরা হয়নি।’

বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান থেমে নেই: পুরোনো অনেক ব্যবসা ধরে রাখার পাশাপাশি ইস্পাহানি গ্রুপ নতুন নতুন ব্যবসায়ও যুক্ত হয়েছে। চা বিপণন ও উৎপাদন, টেক্সটাইল, আবাসন, খাদ্যপণ্য, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, কনটেইনার ডিপো, প্যাকেজিং, জুট বেলিং, সিকিউরিটিজ এবং পর্যটন খাতে ব্যবসা রয়েছে এখন গ্রুপটির। গ্রুপটির অধীনে রয়েছে ১৮টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।

২০২ বছর ধরে ব্যবসা করে আসা ইস্পাহানি গ্রুপ কখনো কোনো খাতে আগ্রাসী বিনিয়োগে যায়নি। কৃষি খাতের কথাই ধরি। ২০০৭ সালে প্রথমে বীজ বাজারজাত দিয়ে যুক্ত হয় গ্রুপটি। দুই বছর পর জৈব কীটনাশক এবং তিন বছর পর সুগন্ধি চাল দিয়ে কৃষি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় বিনিয়োগ করে তারা। সর্বশেষ ২০২০ সালের শেষে দিনাজপুরে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইস্পাহানি অটো রাইস মিল স্থাপন করেছে গ্রুপটি। এভাবে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে নতুন খাতে।

দুই দশক আগে খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হওয়া ইস্পাহানি প্রিমিয়াম বিস্কুট, টোস্ট, পাউডার ড্রিংক, চিপস বাজারজাত করছে। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও। বছরে ২৫০ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। পুরোনো পাটকল ছেড়ে এখন টেক্সটাইল খাতেও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে ইস্পাহানি। কয়েক বছর আগে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ‘পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিলস’ কারখানা সম্প্রসারণ করেছে গ্রুপটি। তাতে টেক্সটাইল কারখানার বার্ষিক লেনদেন বেড়ে ৬০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।

২০১৮ সালে চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীতে ভিক্টরি জুট মিলের জায়গায় সামিট গ্রুপ ও অ্যালায়েন্স হোল্ডিংস লিমিটেডের সঙ্গে মিলে কনটেইনার ডিপো গড়ে তুলেছে। প্রায় ১৩০ কোটি টাকায় এখন গাজীপুরে চায়ের অত্যাধুনিক কারখানা গড়ে তুলছে গ্রুপটি। ঢাকা ও খুলনায় পর্যটন ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিকল্পনাও প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে গ্রুপটি।

বর্তমানে বছরে নিজেদের কারখানায় উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াজাত হওয়া প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করছে গ্রুপটি। গ্রুপটির কর্মিসংখ্যা এখন ১২ হাজার, যাঁদের পরিবারের অংশ হিসেবে মনে করে ইস্পাহানি পরিবার। বিনা খরচে শ্রমিক ও মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে গ্রুপটি। করোনার সময় ইস্পাহানির কর্মীদের পদোন্নতি বা সুযোগ-সুবিধা কিছুই কাটছাঁট হয়নি। চাকরিও যায়নি কারও।
শেষের কথা

বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসির অধিগ্রহণে আসা দ্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা লিওনেল ব্ল্যাঙ্কস ’৪৭ সালে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছিলেন, দেশভাগের আগে অস্থির সময়ে চট্টগ্রামে হংকং ব্যাংকের শাখা খোলার উপযুক্ত সময় নয়। অবশ্য ইস্পাহানি পরিবার হংকং ব্যাংকের নতুন শাখা খোলার পরামর্শ দিয়েছিল বলেও তিনি ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরেন। ইস্পাহানি পরিবারের দূরদর্শী মতামত যে ঠিক ছিল, তা ইস্পাহানি গ্রুপের অগ্রগতি বা চট্টগ্রাম ঘিরে বাংলাদেশের অগ্রগতির মধ্য দিয়ে এরই মধ্যে প্রমাণিত।

’৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সব কারখানা জাতীয়করণ করা হলে ইস্পাহানির চা-বাগান ও কারখানাও সরকারের হাতে চলে যায়। তবে ফিরিয়ে দিতে খুব বেশি সময় নেয়নি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। এক চিঠিতেই মির্জা সালমান ইস্পাহানির দাদাকে বাগান-কারখানা ফিরিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকে ইস্পাহানি গ্রুপও এ দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ক্রীড়ায় অবদান রেখে চলেছে।

বিশ্বের অনেক দেশ-শহরে ব্যবসার প্রসার ঘটালেও ৭৫ বছর আগে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশকে প্রধান কার্যালয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল ইস্পাহানি। এ সময়ে শুধু বাংলাদেশিই হয়নি, সততা-নৈতিকতা মেনে যে ব্যবসা করা যায়, তারও পথ দেখিয়েছে গ্রুপটি। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডকে বিশ্বে পরিচিত করেছে। ২০২ বছরের পারিবারিক ব্যবসা শুধু ইস্পাহানির নয়, এ দেশের জন্যও গৌরবের। তথ্যসূত্র: প্রথম আলো।