শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: মাস্ক জালিয়াতির পর এবার পুঁজিবাজারে লুটপাট করতে আসছে জেএমআই গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মহাজন’ হিসেবে পরিচিত ছোট একটি কোম্পানির ‘বড় দান’ মারার লিপ্সায় মহামারি করোনার ঝুঁকিতে ফেলে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছেন জেএমআই সিরিঞ্জের এমডি রাজ্জাক সহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ভুয়া এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে চিকিৎসকদের।

আর যারা এসব ভুয়া মাস্ক গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তাদের বদলিসহ নানা হয়রানি করা হচ্ছে। আমেরিকায় উৎপাদিত এন-৯৫ এর কোনো পণ্য চালান দেশেই আসেনি। অথচ মহামারির সুযোগে ভুয়া মাস্ক তৈরি করে এন-৯৫ এর প্যাকেটে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির মুল হোতা জেএমআই সিরিঞ্জের এমডি রাজ্জাক বলে দেশবাসীর মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএমএসডিকে ভুয়া এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা জেএমআই সিরিঞ্জ এন্ড মেডিকেল ডিভাইস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বৃহৎ করদাতা বিবেচনায় গত বছর সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন নোয়াখালীর এই ব্যবসায়ী।

এদিকে এন-৯৫ মাস্ক জাতিয়াতির ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএমআই’র কর্ণধার আবদুর রাজ্জাকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি প্রভাব বিস্তারও। তাই অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে মহামারিতে ডাক্তার-নার্সদের জীবনকে ঝুকিঁতে ফেলে দেয়া জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের এবার নজর পুঁজিবাজারে। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে চায়।এ জন্য ইতিমধ্যে রোড শো করেছে কোম্পানিটি। অপেক্ষায় আছে বিডিং ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের(বিএসইসি) অনুমোদনের।

জীবন রক্ষাকারী এন-৯৫ মাস্ক এর নামে নকল মাস্ক এ কোম্পানিটি থেকে সরবরাহ করে ডাক্তার-নার্সদের ঝুকিঁ তৈরী করা হয়। পরে আবার দায়মুক্তি চেয়ে ক্ষমাও চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিনিয়োগকারীরা এ প্রতিষ্ঠানটিকে আর পুঁজিবাজারে দেখতে চান না। তাদের দাবি, যে কোম্পানির কাছে টাকাই সব, জীবনের মূল্য নেই। সে কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন নেই। এ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়া হলে আন্দোলন করা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সব কোম্পানিরই প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসার অধিকার আছে। তবে আইপিও অনুমোদনের দেওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানির ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের মানবিক দিকগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। এরকম অবিবেচক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ চিন্তা করে না। এসব কোম্পানির আইপিও না দেয়াই ভালো।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনাভাইরাসের কারনে সারা পৃথিবী এখন ডাক্তারদের দিকে তাকিয়ে। তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের বাচাঁনোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর তাদেরকেই যদি নকল মাস্ক সরবরাহ করে ঝুকিঁতে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে এরচেয়ে ঘৃণ্য কাজ আর কিছু হতে পারে না। আর যাই হোক এ জাতীয় কোম্পানিকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো কিছু করবে এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না।

জেএমআই হসপিটাল বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা উত্তোলন করতে গত বছরের ২০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার রোড শো করে। ওই টাকা দিয়ে জমি ক্রয়, ভবন তৈরী, মেশিনারীজ ক্রয়, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করতে চায়। এই টাকা উত্তোলনের কাজে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এবং জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, এন-৯৫ লেখা বক্স, কিন্তু ভিতরের যে জিনিসটা, সেটা দেখা দরকার। এখানে নজড় দেন। লেখা এন-৯৫ থাকলেও ভিতরে সবসময় সঠিকটা যাচ্ছে না। কেউ যদি এরকম কিছু করে থাকে এবং তার সাপ্লায়ার কে?

বাবুনগর হাসাপাতালে এমন গেছে। ওটাতো করোনাভাইরাসের জন্য ডেডিকেটেড। এমন যদি কিছু কিছু জায়গায় হয়, সেটাতো ঠিক না। তাই যাদেরকে এইসব পণ্য সরবরাহের ব্যবসা দেওয়া হয়, সেদিকে নজড়দারি বাড়ানো দরকার। কারন বক্স ঠিক থাকলেও ভিতরে থাকছে না। তাই যিনি পণ্য গ্রহণ করবেন, তিনি যেনো দেখেশুনে নেন, আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই।

জানা গেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ২০ হাজার ৬০০ পিস মাস্ক এন-৯৫ হিসেবে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) সরবরাহ করেছিল জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। দুটি চালানের মাধ্যমে এই মাস্ক সরবরাহ করেছিল। প্যাকেটের মোড়কে এন-৯৫ মাস্ক লেখা থাকলেও ভিতরে পাওয়া যায় নকল মাস্ক নয়। যা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিদর্শনে উঠে আসে। ফলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের ভাণ্ডার ও রক্ষণের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্প্রতি এ নিয়ে জেএমআই হসপিটালকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেয়ার নির্দেশ দেন।

বিষয়টি স্বীকার করে জেএমআই হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক চিঠির জবাবে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে সংকটময় সময়ে মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছে। জেএমআই হসপিটাল স্বপ্রণোদিত হয়ে মাস্ক তৈরির চেষ্টা করছে, যা এখনো প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে।

যে সময় মাস্কগুলো সরবরাহ করা হয়, তখনো দেশে এন-৯৫-এর স্পেসিফিকেশন সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ছিল না। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে বেশকিছু পণ্য সরবরাহ করে।

সরবরাহকৃত পণ্যের সঙ্গে ভুলক্রমে প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে তৈরীকৃত ২০ হাজার ৬০০ পিস এন-৯৫ মাস্ক অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা এন-৯৫-এর স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে ‘কমপ্লাই’ করে না। চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও উপরোক্ত ব্যাখ্যা সদয় বিবেচনাপূর্বক সরবরাহকৃত মাস্ক ফেরত দিয়ে আমাদের অনিচ্ছাকৃত সম্পাদিত ভুলের দায় হতে মুক্তি দানে বাধিত করবেন।’