শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: করোনাভাইরাস আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি বাড়ায় পুঁজিবাজারে বড় ধস নেমেছে। ফলে গত এক সপ্তাহে পুঁজিবাজারে বড় ধস নামছে। টানা বড় পতনে পুঁজি নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। অব্যাহত পতনে তলানিতে নামা পুঁজিবাজার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে স্টেকহোল্ডাররা এখন উদ্বিগ্ন। এই পতনের শেষ কোথায় এ বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্যই করছে না।

২০১৯ সালজুড়ে চলা মন্দাবস্থা কাটিয়ে তুলতে প্রত্যেকটি ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকা করে বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ফেব্রুয়ারিতে সার্কুলার জারির পর তহবিল গঠনের পর্যায়ে রয়েছে ব্যাংকগুলো। তফসিলি সব ব্যাংক তহবিল গঠন করলে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা তারল্য আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

সরকারি নির্দেশনা ও ব্যাংকের বিশেষ তহবিল গঠনের মধ্যে দেশে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। মন্দাবস্থায় থাকা পুঁজিবাজারকে জাগিয়ে তুলতে সব মহলের চেষ্টার মধ্যে করোনা আঘাতে পর্যুদস্ত হয়েছে বাজার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অর্থনীতিতে মন্দাবস্থার শঙ্কায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী দেদার শেয়ার বিক্রি করছে। এই অবস্থায় বড় বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে সক্রিয় হওয়ার বিপরীতে শেয়ার বিক্রি করে নিরাপদ অবস্থান খুঁজছে। আর কেনার চেয়ে শেয়ারের দাম কম হওয়ায় মূলধন খোয়াচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে পুঁজিবাজার নিয়ে স্টেকহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সবার মনেই একই প্রশ্ন এই পতনের শেষ কোথায়?

সূত্র জানিয়েছে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা করোনার কারণে আতঙ্কিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। তারল্য জোগান বাড়াতে বিশেষ তহবিল ছাড়ের বিষয়েও দ্রুত আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোও তারল্য জোগান পেয়ে বিনিয়োগের আশ্বাস দিচ্ছেন। তবুও পুঁজিবাজারে আস্থা বাড়ছে না। বরং অনাস্থার কারণে প্রতিদিনই বিক্রি বেড়েই চলেছে।

করোনাভাইরাস আতঙ্কে ভয়াবহ ধসের কবলে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণাও ধস ঠেকাতে পারছে না। এই পতনের কবলে পড়ে শেষ ১০ কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ৮৬৩ পয়েন্টই নেই হয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রকোপে বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব শেয়ারবাজারে ধস চলছে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও। তবে ৮ মার্চ বাংলাদেশ প্রথম তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ পেলে আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে ৯ মার্চ শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামে।

ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স একদিনে রেকর্ড ২৭৯ পয়েন্ট পড়ে যায়। এরপর একে একে আট দিন চলে গেলেও বড় ধসের কবল থেকে বেরোতে পারেনি শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজরে একের পর এক বড় ধস নামায় ১৬ মার্চ ব্যাংক মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠক শেষে ব্যাংকগুলো বুধবার (১৮ মার্চ) থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তবে এ ঘোষণাও শেয়ারবাজারের ধস ঠেকাতে পারেনি।

আজ পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের খবরে শুরুতেই মাত্র ৫ মিনিটে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০৬ পয়েন্ট বেড়ে যায়। তবে সাত মিনিট থেকে আগের রূপ অর্থাৎ পতন শুরু হয়। এরপর পতন কখনো বেড়েছে আবার কখনো কমেছে। এভাবে দিন শেষে ১৬৯ পয়েন্ট ৪.৪৭ শতাংশ কমে ডিএসইএক্স সূচক দাঁড়িয়েছে ৩৬০৪ পয়েন্টে।

এর মাধ্যমে ডিএসইর এই সূচকটি ৬ বছর ১০ মাস ৬ দিন বা ১ হাজার ৬৫৬ কার্যদিবস বা ২০১৩ সালের ১২ মে’রমধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে। এর আগে ২০১৩ সালের ৯ মে আজকের থেকে কম অর্থাৎ ৩৫৪৯ পয়েন্টে অবস্থান করছিল ডিএসইর এই সূচকটি।

আলী কবির নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, বুঝতে পারছি না শেয়ারবাজার কোন দিকে যাচ্ছে। এটাকি নাই হয়ে যাবে না কি কিছুটা বেচে থাকবে। এই বিনিয়োগকারী আরো বলেন, সোমবার অর্থমন্ত্রীর সাথে এবিবি ও বিএবি’র বৈঠকে ব্যাংকগুলো আজ থেকে বিনিয়োগে আসার কথা বলেছে। ব্যাংকগুলো সত্যি যদি আজ থেকে বিনিয়োগে আসে তবে কারা এই বাজারকে পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। না হয় বন্ধ করে দেয়া উচিত এই শেয়ারবাজার।

কয়েকজন বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বাজারকে সাপোর্ট দিতে যথেষ্ট চেষ্টা করছে। যেখানে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে সেখানে আজ শেয়ারবাজার এভাবে পরতে পারে না। কারা, কেন এবং কি উদ্দেশ্যে এভাবে ক্ষতির মধ্যেও শেয়ার বিক্রয় করছেন তাও খতিয়ে দেখতে হবে।

ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ৩৯ পয়েন্ট, ডিএসই-৩০ সূচক ৬১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮৩৫ ও ১২০৩ পয়েন্টে। ডিএসইতে আজ টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৪২৯ কোটি ৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। যা আগের দিন থেকে ২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বেশি। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৪০৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকার।

ডিএসইতে আজ ৩৫৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টির বা ৪ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। দর কমেছে ৩৩৩টির বা ৯৪ শতাংশের এবং ১০টি বা ২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে।

ডিএসইতে আজ টাকার পরিমাণে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে স্কয়ার ফার্মার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকার গ্রামীণফোনের এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে মুন্নু সিরামিকের। এছাড়া ডিএসইতে টপটেন লেনদেন থাকা অপর কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- লাফার্জ হোলসিম, ওরিয়ন ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, বৃটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, খুলনা পাওয়ার, বেক্সিমকো এবং সী পার্ল।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এদিন ৪৪৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ১৩৪ পয়েন্টে। এদিন সিএসইতে হাত বদল হওয়া ২৪৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ১৯টির, কমেছে ২১৯টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১০টির দর। আজ সিএসইতে ১৫ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘টানা দরপতনে আমরা বাকরুদ্ধ। শেয়ারবাজারে দরপতন তো চলছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা দেখেও না দেখার ভান করছে। বর্তমান পুঁজিবাজার ২০১০ সালের মহাধসের থেকে বর্তমান পুঁজিবাজারের অবস্থা ভয়াবহ। বিনিয়োগকারীদের শতকরা ৮০ শতাংশ পুঁজি শেষ। প্রতিনিয়ত আমাদের বিনিয়োগকারী ভাইয়েরা পুঁজি হারাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে একপর্যায়ে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে।’

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও আন্দোলনকারী নেতা কিবরিয়া মিয়া বলেন, পুঁজিবাজারের যে পরিস্থিতি চলছে তাতে আত্মহত্যার বিকল্প নেই। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন আমাদের বাঁচান বলে দীর্ঘ নি:শ্বাস নিয়ে চেখের পানি ছেড়ে দেন তিনি।

বিনিয়োগকারী ঐক্য পষিদ নেতা আতাউল্লাহ নাইম বলেন, পুঁজিবাজার এখন মুমুর্ষু অবস্থায় রয়েছে। পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন দোলাচলে রয়েছেন। প্রত্যক দিন পতন হচ্ছে, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। আইসিবি এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আস্থা ও তারল্য সংকট দূরের লক্ষ্যে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের সুবিধাগুলো আদায়ে ব্যস্ত তারা, বাজারকে সাপোর্ট দিচ্ছে না।