শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: টানা পতনের বৃত্ত থেকে বের হয়ে পুঁজিবাজারে এখন স্বস্তির আভাস। বাজারে আস্থা ও তারল্য সংকট দূর করতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেশ কিছু উদ্যোগের পর টানা চার কার্যদিবসে বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। বেশিরভাগ শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে বাজার মূলধন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা করে বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দেয়ায় দেশের শেয়ারবাজারে সূচক ও লেনদেনের পালে হাওয়া লেগেছে।

সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এক বছর পর আবারও ৯০০ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়েছে। এক লাফে প্রধান সূচক বেড়েছে ১৬৯ পয়েন্ট বা প্রায় ৪ শতাংশ। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্য সূচক বেড়েছে ৫৩৩ পয়েন্ট। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ডিএসইতে প্রধান মূল্যসূচক হিসেবে চালু হওয়া ডিএসইএক্স’র এটি একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান। এর আগে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি একদিনে সূচকটি ২৩২ পয়েন্ট বেড়েছিল। তার আগে ২০১৫ সালের ১০ মে সূচকটি একদিনে বেড়েছিল ১৫৫ পয়েন্ট।

ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে শেয়ারবাজারে স্টেকহোল্ডারদের একটি অংশের দাবির প্রেক্ষিতে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য প্রত্যেকটি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করতে পারবে।

নিজস্ব উৎস অথবা ট্রেজারি বিল বন্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো এ অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫ শতাংশ সুদে এ তহবিলের অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে ব্যাংকগুলো, যা পরিশোধের সময় পাবে পাঁচ বছর। ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে এ তহবিল থেকে ঋণ দিতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সুবিধা দেয়ার পর গত মঙ্গলবার থেকে পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন দেখা দেয়। সেই সঙ্গে লেনদেন বেড়ে ৫০০ কোটি টাকার ঘরে পৌঁছে। পরের কার্যদিবস বুধবার ডিএসইতে ৬০০ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন হয় ৭০০ কোটি টাকার ওপর। আগের তিন কার্যদিবসের মতো চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার লেনদেনের শুরুতে শেয়ারবাজারে বড় উত্থানের আভাস দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে।

এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স সূচকটির রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়েছে। এদিন ডিএসইএক্স বেড়েছে ১৬৯ পয়েন্ট। যা সূচকটি চালু হওয়ার ৭ বছরের মধ্যে একদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান। ডিএসইতে ডিএসইএক্স সূচকটি ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪০৫৬ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপরে বিগত ৭ বছরের মধ্যে সূচকটির আজ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্থাৎ ২৩২ পয়েন্ট উত্থান হয়েছিল। আর ২০১৫ সালের ১০ মে সূচকটি একদিনের ব্যবধানে তৃতীয় সর্বোচ্চ উত্থান বা ১৫৫ পয়েন্ট বেড়েছিল।

১ বছরের বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজার মন্দাবস্থায় ছিল। এতে বিনিয়োগকারীদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজারের উন্নয়নে গত ১৬ জানুয়ারি উচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং কয়েকটি নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বৈঠকের পর ১৯ জানুয়ারি সূচকটি ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে শেয়ারবাজার আবার মন্দায় পতিত হয়।

সর্বশেষ গত ১০ ফেব্রুয়ারি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য প্রত্যেক ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকা করে ফান্ড গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করে। ওই সার্কুলার জারির পর থেকে শেয়ারবাজারে সূচক ও লেনদেন বাড়তে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় আজ ডিএসইর সূচক ডিএসইএক্স ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেড়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের আশা, আস্থাহীনতার বৃত্ত কেটে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীরাও তাদের পুঁজি ফিরে পাওয়ার আশায়। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসে গতি ফিরে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এতে করে বাজার আরও গতিশীল হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

মশিউর সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী কালাম খান বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে পুঁজিবাজারে দরপতনে আমি প্রায় অর্ধেক পুঁজি হারিয়ে ফেলেছি। গত চার কার্যদিবস ধরে বাজার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। আমি এখন খুবই আশাবাদী বাজার স্থিতিশীল হবে।’

পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে সরকারি উদ্যোগের দাবিতে গত এপ্রিলে অনশন থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও। চূড়ান্ত হতাশায় পড়া বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদও এখন আশাবাদী হয়ে উঠছে। পরিষদের সাধারন সম্পাদক কাজী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘সরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। পাশপাশি পুঁজিবাজারে চাঙ্গা করতে সম্প্রতি সরকারি ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা করে বিশেষ তহবিলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, ইস্যুমূল্যের চেয়ে দর নেমে গেলে কোম্পানির মালিক পক্ষ যেন বাজার থেকে শেয়ার কিনে নেয়। এ জন্য বাই ব্যাক আইনের প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) সভাপতি মো: ছায়েদুর রহমান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বিশেষ তহবিল গঠনের অনুমোদনে খুশি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে সম্প্রতি সরকারি ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা করে বিশেষ তহবিল গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নিদের্শনার পরই পুঁজিবাজার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনাকে পুঁজিবাজারের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুঁজিবাজার উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক এক যুগান্তকারী নীতি সহায়তার সার্কুলার দিয়েছে, যা ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ও সাহস জোগাচ্ছে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, “সত্যিকার অর্থে সরকারের ভালো সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। সরকারের নানা উদ্যোগ ও আন্তরিকতার ফলে লেনদেন হাজার কোটি টাকার ঘরে। আশা করি পুঁজিবাজারের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো বলেন,

বাংলাদেশ ব্যাংক সবার জন্য একটা ভালো সুযোগ দিয়েছে। এটা সত্যিকার অর্থে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। প্রত্যেক ব্যাংক এখন তার সীমার বাইরেও ২০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। ব্যাংকের বিনিয়োগের প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়তে শুরু করছে।

সরকারের নানা উদ্যোগ সন্তোষ প্রকাশ করে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, “সরকার পুঁজিবাজারের জন্য খুবই ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে।
সরকারের পদক্ষেপের প্রভারে লেনদেন হাজার কোটি টাকা ঘরে। এটা বিনিয়োগকারীদের জন্য দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। পুঁজিবাজারের এ গতি চলমান থাকলে আস্থা হারানো বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার মুখী হবেন, তেমনি পাল্টে যাবে পুঁজিবাজারের হিসেব নিকেশ।