জুয়াড়ীদের কবল থেকে পুঁজিবাজারকে রক্ষা করুন
ইসমাত জেরিন খান: এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পুঁজিবাজার এখন জুয়াড়ীদের দখলে। কেননা প্রতিদিনই হতাশায় দিন কাটাতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। আর এই সুযোগে পুঁজিবাজারে একটি বিশেষ মহল গুজব নির্ভর সংবাদ ছড়িয়ে বাজারকে অনেকবারই কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর চেষ্টা করেছে।
গত কয়েক সপ্তাহজুড়েই বিনিয়োগকারীদের কাছে গুজব ছড়ানো হয়েছিল শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারে এক্সপোজার লিমিটের সময় বাড়ানো না হলেও গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর ধারণকৃত অতিরিক্ত বিনিয়োগ কোনো প্রকার শেয়ার বিক্রি না করে আইনি সময়সীমার মধ্যে নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে আনার জন্য কিছু নীতি সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যার মধ্যে প্রধান সিদ্ধান্ত হচ্ছে এক্সপোজারের কম্পুনেন্ট বা উপাদান হিসাবকরণ কিছুটা পুনর্বিন্যাসসহ কিছু অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের সাবসিডিয়ারি মূলধন বৃদ্ধি করা হবে। গতকালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় করতে হবে। শুধু মূলধন বাড়িয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সমন্বয়ের সুযোগ পাচ্ছে সাধারণ বিনিয়োকারীরা।
এদিকে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছিলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা এই মুহূর্তে বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। যা সময়ের দাবি।
মূলধন বাড়িয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সমন্বয়ের সুযোগ দেয়া হলেও পুঁজিবাজারে কারসাজিকারীদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েই গেছে। এর আগে সময় বাড়ানোর কথা থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে কোনো সময় বৃদ্ধি করেনি।
বরং শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আগের মতোই রিটেইন আর্নিংসের পঁচিশ শতাংশ হতে পারবে বলে মত দেয়। বাজারে এই সিদ্ধান্তের পর এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে বিভিন্ন মহল। বাজারে যার সুযোগ নিচ্ছে কুচক্রী মহল। তারা প্রায়ই গুজব রটাচ্ছে ব্যাংকের বিনিয়োগ সময়সীমা নিয়ে।
এ কারণে পুঁজিবাজারে কয়েকদফা বাজারের উত্থান-পতন দেখা যায়। যেখানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক নেমে আসে ৪ হাজার ২৩৮ পয়েন্টে। এদিকে একটানা সূচকের নেতিবাচক প্রবণতায় যখনই বাজারে এ ধরনের সংবাদ আসে তখনই বিশেষ মহল সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করছে।
নতুন করে পুঁজিবাজারে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সংস্কার এবং অতিরিক্ত প্রিমিয়ামে যেসকল কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসছে তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কেন পুনরায় এধরনের ঘটনা ঘটছে। এর আগে যখন প্রথম বুকবিল্ডিং পদ্ধতি চালু হয় তা সঠিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
আর একারণে অনেকটা চাপের মুখেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বন্ধ করতে হয়েছিল বুক বিল্ডিং পদ্ধতি। সর্বস্বান্ত হয়েছিল অনেকেই। আর সুযোগ গ্রহণ করেছিল বাজার লুটকারীরা।এখন আবার নতুন করে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সংস্কার করা হলেও অতিরিক্ত প্রিমিয়ামে শেয়ার ছাড়ছে কোম্পানিগুলো। যা বাজারকে দীর্ঘ সময়ের জন্য নেতিবাচক দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
পুঁজিবাজারে ২০১০ সালের ধস ভুলবার নয় বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মামলার সঠিক বিচার হওয়ার জন্য স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এখনও ২০১০ সালের মামলাগুলো ঝুলে রয়েছে। সঠিক কোনো বিচার পায়নি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘ দিনের দাবি যারা আসামী হিসেবে আছে তারা সত্যিই দোষী হলে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা আর যারা নির্দোষ তাদের খালাস করে দেয়া।
কয়েকদিন আগে সিকিউরিটিজ প্রমোশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড- এসপিএম-এর শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলায় অভিযুক্ত দুই আসামিকে ২ বছর করে কারাদণ্ড এবং ১৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন পুঁজিবাজার মামলা নিষ্পত্তিতে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।
মামলার আসামি এসপিএমের চেয়ারম্যান শেলী রহমান ও প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সৈয়দ মহিবুর রহমান। মজার বিষয় মামলার শুরু থেকেই তারা পলাতক রয়েছেন। ২০০৪ সালে বিএসইসির তৎকালীন সদস্য মোহাম্মদ আলী খান ও পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বাদী হয়ে বিএসইসির পক্ষে মামলাটি দায়ের করেন।
তবে এধরনের অনেক মামলা এখন হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে। অনেকে ১৯৯৬ সালের মামলার আসামী হয়েও পুঁজিবাজারের প্রধান নেতৃত্বের জায়গায় রয়েছে। এধরনের পরিবেশ পুঁজিবাজারের জন্য নেতিবাচক। যদি কেউ বাজারে নির্দোষ হয়ে থাকে তাদের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। কিন্তু যদি মামলার কার্যক্রম নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লাগে তা বিনিয়োগকারী ও বাজারের জন্য নেতিবাচক।
বাজারকে সঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন নতুন নেতৃত্ব। পুঁজিবাজার বর্তমানে অনেকটাই অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ খালি হওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে নতুন নিয়োগ দেয়ার শর্ত রয়েছে। নতুন ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনে। তবে সিএসই এখনও পর্যন্ত এমডির নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারে নি। আর ডিএসইর এখনও নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। দেশের প্রধান দুটো শেয়ারবাজার দীর্ঘ সময়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ শূন্য থাকা বাজারের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা বলাবাহুল্য।
এদিকে একের পর এক আইপিও পুঁজি বাজারে আনা এবং ২০১০ পরে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পার হলেও এতদিন পর আইপিও ইস্যুতে বিএসইসির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতদিন ধরে বিনিয়োগকারীরা যখন বাজারে চিৎকার দিয়ে বাজে আইপিও বন্ধের দাবি জানিয়েছিল তখন নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
তবে দীর্ঘদিন পরে হলেও গত ২৯ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিএসইসি ও বিআইসিএম শাখা থেকে উপ-সচিব মো. মতিউর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি বিএসইসিতে পাঠানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবহিকভাবে শেয়ারবাজারে নতুন যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে কিছুদিন যেতে না যেতেই অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম আইপিওর দামের চেয়ে নিচে নেমে গেছে। যা পুঁজিবাজারে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে। ২০১০ সালের পর ৭০টির বেশি কোম্পানি/মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ারবাজারে এসেছে। যার বেশিরভাগ কোম্পানি মানহীন। পুঁজিবাজারের অভিভাবক যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আর তাদের হাত ধরে যখন এধরনের ঘটনা ঘটে তখন বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আস্থা না থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এতকিছুর পরও বাজারে রয়েছে আশার আলো। একটু দায়িত্বশীল হলেই এধরনের সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। তাই দরকার শেয়ারবাজারে নতুন নেতৃত্ব। পুঁজিবাজারে সরকার যতটা আন্তরিক রয়েছে সেভাবে যদি দায়িত্বশীল প্রতিটি মহল দায়িত্ব পালন করে এই বাজারের প্রতি বিনিযোগকারীদের আস্থা ফেরানো সম্ভব। এদিকে বাজেট আসন্ন। বাজেটকে কেন্দ্র করেও অনেকেই আশার আলো দেখছেন।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হতে প্রাপ্ত লভ্যাংশে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। বর্তমানে ২৫ হাজার টাকা লভ্যাংশ পেলে বিনিয়োগকারীকে কর দিতে হয়। পুঁজিবাজারে যদি ভালো মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে নিয়ে আশা যায় তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাথে দেশী বিনিযোগকারীরাও লেনদেনে আগ্রহী হবে। সেই সাথে অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে আনার বিষয়ে আবার ভেবে দেখা দরকার রয়েছে।
এদিকে পুঁজিবাজারে অর্থ সংকট থাকলেও ব্যাংকে বিপুল অলস অর্থ দীর্ঘ মেয়াদী অর্থনীতিতে প্রভাব পড়তে পারে। এখন সময় হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজারের প্রতি নমনীয় হওয়া। এবং শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো।
একবারে বাড়ানো সম্ভব না হলেও যদি কয়েক ধাপে বাড়ানো হয় তাহলে একদিকে পুঁজিবাজারে যেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তেমনি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থা তৈরি হবে। তাই সময় হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ে ভাবার। বাজার নিয়ে সরকার যেমন আন্তরিক রয়েছে তেমনি প্রত্যেক মহল তাদের নিজেদের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা না করে বাজারের স্বার্থে কাজ করলে বাজরের পরিবর্তন আসবেই।
লেখক : বিজনেস এডিটর, এটিএন বাংলা