শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মো. আব্দুল হালিম বলেন, অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন হয়েছে সে অনুযায়ী আমাদের ভূমিকা পরিবর্তন হওয়া উচিত। ২০২৫ সালের মধ্যে ডেরিভেটিভস পণ্য চালু হবে বলে আমি আশাবাদী। এরমধ্যে সিসিবিএল (সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড) তার কার্যক্রম শুরু করবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) আয়োজিত ‘ফিন্যান্সিয়াল ডেরিভেটিভস অব এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড প্ল্যাটফর্ম-এম’ শীর্ষক এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন ডিবিএর প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম।

শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে বাজার এ অবস্থায় থাকবে না। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অনেক ভালো হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে বাজার ভালো করে দেবে না। এখানে যারা আছে তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে এখানে কী সমস্যা আছে, আর কী কাজ করা যায়। তাহলেই বাজার ভালো হবে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), সিডিবিএল, সিসিবিএল, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীদের অংশগ্রহণে গাজীপুরের ব্র্যাক সিডিএমে দুই দিনব্যাপী (২ থেকে ৩ মে) এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।

আব্দুল হালিম বলেন, ডেরিভেটিভস নিয়ে আজকের ওয়ার্কশপই শেষ নয়। এটা নিয়ে আরও অনেক প্রোগ্রাম করতে হবে। বিশ্বের অনেকে দেশে এ বিষয়ে অনেক আগে থেকে চালু আছে। তাই যারা এ বিষয় নিয়ে কাজ করবেন তাদের প্রয়োজনে সেসব দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে। শুধু ইক্যুইটি দিয়ে মার্কেট বড় হবে না। মার্কেট বড় করতে আরও বিভিন্ন ধরনের পণ্য দরকার। সিসিবিএলের কিছুটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরই মধ্যে ডেরিভেটিভস নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং সিএসই কমোডেটিজ নিয়ে কাজ করছে। সিএসই কমোডেটিজ ২০২৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে চালু করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

তিনি বলেন, গতানুগতিক চিন্তা করলে হবে না। একটু ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। বাজারে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। শুধু করার জন্য ওয়ার্কশপ করলে হবে না। আপনাদের ভাবতে হবে আমরা এটা করবো। সেক্ষেত্রে সিসিবিএলের সমস্যা দেখবো না, সিসিবিএলের বড় শেয়ারহোল্ডার ডিএসই। প্রয়োজনে তাদের সমস্যার কথা জানান। দরকার হলে সেগুলো নিয়ে আলাদা ওয়ার্কশপ করেন।

বিশেষ অতিথি ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশের শেয়ারবাজারে পণ্যের ভিন্নতা আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো পিছিয়ে রয়েছে। তবে আজকের এ আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে ধন্যবাদ জানাই। এ বিষয়ে ডিএসইকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ যদি ডিএসই কাজ না করে তাহলে বিএসইসি কিছুই করতে পারবে না।

তিনি বলেন, পণ্যে ভিন্নতা আনতে অনেক আগে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সেজন্য এ বাজারে কোনো মেধাবী থাকে না। কারণ যারা আসে, তারা এখানে কাজ করার মতো কোনো নতুন পণ্য পায় না। আমাদের বাজার মূলত ইক্যুইটি কেন্দ্রিক। আর বর্তমানে বাজারে মাত্র ৪০০ কোম্পানি আছে, যেখানে বাংলাদেশে কোম্পানির সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা মাত্র ১৭ লাখ। ফলে এসব জিনিস বিএসইসি ও ডিএসইর লক্ষ্য করা উচিত, আসলে সমস্যা কোথায়? বাজার ভালো করতে হলে পণ্যে ভিন্নতা আনতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মার্কেটে বন্ড নিয়ে অনেক আগে থেকে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা এখনো ভালো করে কার্যকর হয়নি। আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ট্যাক্স ইস্যু। এ বিষয় নিয়ে আমরা বিএসইসি ও এনবিআর একসঙ্গে বসে সমাধান করার কথা বলে আসছি। এছাড়া সিসিবিএলের পাঁচ বছর হয়ে গেলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। আর সিসিবিএল ছাড়া পণ্যে ভিন্নতা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বর্তমানে সিসিবিলের সিংহভাগ শেয়ার ডিএসইর কাছে। এছাড়া আরও শেয়ারহোল্ডার আছেন। তারা এ বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া আরও বেশকিছু বিষয় আছে, পণ্যে ভিন্নতা আনতে সেগুলো নিয়ে কাজ করা দরকার।

সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের মার্কেটে পণ্য কম থাকায় কেউ বিনিয়োগ করার সুযোগ পায় না। কেউ যখন শেয়ারে লাভ করে তখন বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায়। কারণ তার কাছে বিনিয়োগের নতুন কোনো সুযোগ থাকে না। আজ যদি নানান ধরনের পণ্য থাকতো তাহলে শেয়ারে বিক্রি করে অন্য পণ্য বিনিয়োগ করতো। তাই বাজার ভালো রাখতে পণ্য ভিন্নতার কোনো বিকল্প নেই। এসব নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত।

কর্মশালা সঞ্চালনা করেন ডিএসই’র মার্কেট ডেভেলপমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. ছামিউল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এটিএম তারিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ডিএসইও তার পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ আনতে আগ্রহী। আমরা নিয়ম/বিধি প্রণয়নের জন্য বিএসইসির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি এবং খুব শিগগির ডেরিভেটিভ মার্কেট শুরু করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এটিএম তারিকুজ্জামান বলেন, আর্থিক খাতের ডেরিভেটিভস পণ্য বাংলাদেশের জন্য খুবই সময়োপযোগী। ডেরিভেটিভস পণ্যগুলো অত্যন্ত পরিশীলিত পণ্য এবং ঝুঁকি কমাতে কার্যকর হাতিয়ার, যা শেয়ারবাজারের তারল্য প্রবাহ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অধিকতর দক্ষতা প্রদান করে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন ধরনের ডেরিভেটিভস পণ্য রয়েছে। ডেরিভেটিভ মার্কেটের আকার ইক্যুইটি বাজারের তুলনায় বহুগুণ বেশি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য পণ্যের বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে তার পার্শ্ববর্তী এক্সচেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কাজ করছে। এছাড়া আরও কিছু আইন, টেকনিক্যাল এবং অবকাঠামো বিষয়সহ বেশ কিছু কাজ করতে হবে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন আমাদের এই মার্কেট খুবই ছোট ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক অনেক বড় মার্কেট দেখার সুযোগ হয়, তার তুলনায় এই মার্কেট কিছুই ছিল না। তখন ভাবতাম এবং আশা করতাম যে আমাদের শেয়ারবাজার বড় হবে। কিন্তু এখনো বড় হয়নি। বাজার এখনো শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। মার্কেট এই অবস্থা হওয়ার কারণ আমাদের মার্কেটে পণ্য কম, ইক্যুইটি কেন্দ্রিক বাজার।

তিনি বলেন, এখানে বিনিয়োগের নতুন কোনো ক্ষেত্র নেই এবং নতুন কোনো পণ্য নেই। ফলে দেশে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন। এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন মিলে ডেরিভেটিভস পণ্য চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এই ট্রেনিং প্রোগ্রাম।

কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিএসইর উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া। মূল প্রবন্ধে তিনি ডেরিভেটিভসের প্রকারভেদ, ডেরিভেটিভ মার্কেটের তাৎপর্য ও প্রভাব, বিশ্বব্যাপী ডেরিভেটিভস মার্কেট বৃদ্ধির কারণ, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ডেরিভেটিভসের বৈশিষ্ট্য, ডেরিভেটিভস মার্কেটে সেটেলমেন্টের ধরন, ফরোয়ার্ড এবং ফিউচারের মধ্যে পার্থক্য, ফরোয়ার্ড কনট্রাক্টের সীমাবদ্ধতা, ফিউচার কনট্রাক্টের সীমাবদ্ধতা, ফিউচার ট্রেডিংয়ের বিভিন্ন টার্ম, ফিউচার কন্ট্রাক্টের স্পেসিফিকেশন, ফিউচার ও অপশনের মধ্যে পার্থক্য, অপশনস ট্রেডিংয়ের বিভিন্ন বিষয়,

অপশন ট্রেডিংয়ের সুবিধা, অপশনের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, অপশন কন্ট্রান্টের স্পেসিফিকেশন, অপশন ট্রেডিং কৌশল, ডেরিভেটিভস ব্যবহার, হেজিং ও এর প্রকারভেদ, মৌলিক ঝুঁকি, ক্রস হেজ ও এর সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি, হেজিংয়ের সীমাবদ্ধতা, এক্সচেঞ্জ প্লাটফর্মে ফিউচারস অ্যান্ড অপশনস ট্রেডিংয়ে জড়িত পক্ষসমূহ, ডেরিভেটিভস ট্রেডিং প্রক্রিয়া, ফিউচার ও অপশনের জন্য স্টক ও সূচক নির্বাচনের মানদণ্ড, বিভিন্ন ধরনের করপোরেট অ্যাকশন ব্যবস্থাপনা, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, মার্জিন ম্যানেজমেন্ট, ইনিশিয়াল মার্জিন, মেইনটেনেন্স মার্জিন ও মার্জিন কল, মার্জিনের পেমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট, সেটেলমেন্টের প্রক্রিয়া এবং সর্বোপরি এক্সচেঞ্জ ডেরিভেটিভস চালু করতে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আলোকপাত করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম ফিউচারস ও অপশনস বিষয়ে আলোচনায় অপশনসের ট্রেডিং স্ট্রাটেজিং, রিটার্ন বৃদ্ধির কৌশল, কভার্ড কল, ভ্যালু প্রটেকশন স্ট্রাটেজি, বুল, বিয়ার ও বাটারফ্লাই ট্রেড, লং ও সর্ট স্ট্রাংগেল, অপশন প্রাইসিং মেথডস, ব্লাক-সোলস মডেল নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও বায়নোমিয়াল ট্রি মডেল, কন্ট্রোল ভ্যারিয়েট টেকনিক, ফিউচার প্রাইসিং, ফিউচার কন্ট্রাকটস, প্রাইসিং ফরোয়ার্ড, স্টক ইনডেক্স, ইনডেক্স আরবিট্রেজ, প্রাইসিং ফরোয়ার্ড বনাম ফিউচারস, লং অ্যান্ড শর্ট পজিশনস, হেজিং প্রিন্সিপাল, শর্ট অ্যান্ড লং হেজ, পারফেক্ট হেজ, বেসিস অ্যান্ড বেসিস রিক্স, হেজ ফরোয়ার্ড বনাম ফিউচারস ও অপটিমাল হেজ রেশিওর ওপর আলোকপাত করেন।