শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা: বিশ্ব পুঁজিবাজার যখন চাঙা, তখনও ধুঁকে ধুঁকে চলছে দেশের পুঁজিবাজার। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পুঁজিবাজার গত কয়েক মাস ধরে চাঙাভাব বিরাজ করছে। গত বৃহস্পতিবার ভারতের বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ অব্যাহত দরপতনে দেশের পুঁজিবাজার প্রায় তলানীতে ঠেকেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মাত্র ছয়টি উদ্যোগের মাধ্যমেই দেশের ঘুরে দাঁড়াতে পারে দেশের পুঁজিবাজার। এই উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রথমত, বাজারে নতুন করে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা। পুঁজিবাজারের এই ত্রান্তিকালে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) ভেঙে দিয়ে বিএসইসিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। তেমনি পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোয় যোগ্য, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ও মার্কেট মেকার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয় সাধন করে বাজারে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। চতুর্থত, পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তেমনি ব্যাই ব্যাক আইন দ্রুত আস্তবায়ন করা। পঞ্চমত, আইসিবিকে দ্রুত শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে আইসিবিকে ডে টেডিং’র ভুমিকায় না থেকে ভাল মৌল ভিত্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে। ষষ্ঠতম, পতনমুখী পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগমুখী করা প্রয়োজন। তেমনি অতিমুল্যায়িত বাজারে শেয়ার বিক্রি করে, দরপতন বাজারে ক্রয় করতে হবে। এটাই মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কাজ।

পুঁজিবাজারের এই পরিস্থিতির জন্য তারল্য সংকটকে প্রধান কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণফোন ইস্যুতে বাজার আরও খারাপ করেছে। এখন এই বাজারকে তুলতে হলে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোনও মাধ্যমে হোক, অবশ্যই বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। তেমনি বর্তমান বাজারে তারল্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই তারল্য সংকট কাটাতে হলে নতুন করে টাকা দিতে হবে।

এদিকে গত কয়েক মাস ধরেই পুঁজিবাজারে ভয়াবহ মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। অব্যাহত পতনের কবলে পড়ে অক্টোবর মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক হারিয়েছে প্রায় তিনশ পয়েন্ট। সূচকের এই বড় পতনের সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেনেও খরা। মাসজুড়েই প্রতি কার্যদিবসের ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে দুই শ থেকে তিন’শ কোটি টাকার ঘরে।

তবে মাসের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন চার’শ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করেছে। গত বৃহস্পতিবার এই বাজারে ৪০৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে। খরার মধ্যে লেনদেন এদিন কিছুটা বাড়লেও সূচকের পতন অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান মূল্য সূচকের পতন হয়ছে। এর মাধ্যমে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে চার কার্যদিবসেই সূচকের পতন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স দশমিক ৩০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৬৮২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসই-৩০ সূচক ৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৬২৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

এদিকে, পুঁজিবাজারের চলমান মন্দায় বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা, পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউজগুলোয়ও দুর্দিন নেমে এসেছে। খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বেশির ভাগ ব্রোকারেজ হাউজ।

প্রসঙ্গত, লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশনের ওপর ভর করেই মূলত ব্রোকারেজ হাউজগুলো চলে। কিন্তু পুঁজিবাজারের চলমান মন্দায় লেনদেন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশন কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে। এদিকে, শেয়ারবাজারের মন্দা পরিস্থিতির জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থাকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থার কারণেই পুঁজিবাজারের গতি ফিরছে না। বিনিয়োগকারীরা গত ২৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে বিএসইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তারা ২১টি দাবিও তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ সভাপতি মিজান-উর-রশীদ চৌধুরী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনসহ সব কমিশনারকে অপসারণ করে সৎ, মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন পুনর্গঠন করা সম্ভব হলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। এ জন্য আমরা বিএসইসির পুনর্গঠন চাই।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদও বিএসইসি পুর্নগঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়ার কারণে বাজারে বিপর্যয় ঘটেছে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘বিএসইসিকে ভেঙে নতুন করে ঢেলে সাজালে চাঙা হতে পারে দেশের পুঁজিবাজার।’

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধের পাশাপাশি বাইব্যাক আইন পাস হলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করা শেয়ারগুলো নিজ নিজ কোম্পানিকে ইস্যু মূল্যে শেয়ার বাইব্যাক করতে হবে। এছাড়া বুকবিল্ডিং পদ্ধতি, ডিরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতি বাতিল করা জরুরি বলেও তারা মনে করেন।