ওয়াহিদুল হক : দেশের পুঁজিবাজারে কাজ করা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আইন অনুযায়ী ইস্যু ব্যবস্থাপনা না করলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ২০১৬ সালের জুলাই নাগাদ নিষ্ক্রিয় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশের পাশাপাশি কড়া হুশিয়ারি দিলেও তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ছয়মাস পেরোলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুঁজিবাজারের এ অভিভাবক সংস্থা।

গত জুলাই নাগাদ বিভিন্ন সময়ে নিষ্ক্রিয় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর তালিকা করে বিএসইসি। তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশের পাশাপাশি কমিশনের পক্ষ থেকে কড়া হুশিয়ারি দেওয়া হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর সময় দেওয়া হলেও এ সময়ের মধ্যে জবাব দিতে পারেনি। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি হওয়ায় পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট আর আন্ডার-রাইটিং করেই বছর পার করছে।

পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তির শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না তাঁরা। মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার বিধিমালা-১৯৯৬ এর মার্চেন্ট ব্যাংক নিবন্ধন সার্টিফিকেট ইস্যুও শর্তাবলী ১১ (ক) ধারা অনুযায়ি, ‘ইস্যু ম্যানেজার, পোর্টফোলিও ম্যানেজার, মার্চেন্ট ব্যাংকার তাহাদের জন্য প্রযোজ্য নি¤েœাক্ত কার্য অবশ্যই সম্পাদন করিবে, যথাঃ (ক) ইস্যু ম্যানেজার কর্তৃক ধারাবাহিক র্পূর্ণ দুইটি ইংরেজী পঞ্জিকা বৎসরে (যাহা ১ জানুয়ারি ২০১০ হইতে গণনা করা হইবে) পুঁজিবাজারে আনয়নের জন্য ন্যূনতম ১ (এক) টি পাবলিক ইস্যুর দালিলিক (ডকুমেন্টেড) প্রস্তাব কমিশনে দাখিল করা’। অতচ আইন প্রণয়নের পরবর্তি সময়ে অন্তত ২১টি মার্চেন্ট ব্যাংকই আইন পরিপালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার শাস্তি হিসেবে এরই মধ্যে কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি ব্যাংককে বিএসইসি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। এতে করে মার্চেন্ট ব্যাংকারদের আইনের প্রতি উদাসিনতার পাশাপাশি বিএসইসি’র মনিটরিংয়ের দূর্বলতাও প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অযোগ্য কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন বাতিল করার জন্য মাঝে একবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু পারিপাশির্^ক পরিস্থিতি এবং প্রভাবশালী মহলের চাপে সে উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিএসইসি’তে দাখিল করা তথ্য ও ঠিকানাতেও মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বিএসইসি। এমনকি অস্তিত্ব সংকটে থাকা বেশকিছু মার্চেন্ট ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে না জানিয়েই লাইসেন্স বিক্রি করে দিয়েছে। বিএসইসি’র একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিসইসি’র মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সাইফুর রহমান বলেন, ‘কমিশনের দায়িত্ব অনেক কিন্তু সে তুলনায় লোকবল কম। তাই কমিশন চাইলেই সবসময় সববিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর এমন অচলাবস্থা কিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়। এ ব্যাপারে বিএসইসি নজর রাখছে’।

একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংকারের সাথে এ ব্যাপারে কথা বললে এ সমস্যার কথা স্বীকার করে তারা বলেন, বাজারে তালিকাভুক্ত হবার ব্যাপারে ইস্যুয়িং কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। আর একারনেই অনেক মার্চেন্ট ব্যাংকাররা কাজ করার মত ইস্যু পাচ্ছে না। আইন লঙ্ঘনকারী এ মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তালিকায় ছিল অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, এবি ইনভেস্টমেন্ট, অগ্রণী ইক্যুইটি এন্ড ইভেস্টমেন্ট, বিএলআই ক্যাপিটাল, ব্র্যাক-ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট, বিজনেস এন্ড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস, ইসি সিকিউরিটিজ, এক্সিম ইসলামি ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামি ক্যাপিটাল এন্ড ইনভেস্টমেন্ট, গ্রীণডেল্টা ক্যাপিটাল, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি (বাংলাদেশ), আইএল ক্যাপিটাল,

যমুনা ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, এনবিএল ক্যাপিটাল এন্ড ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট, রেস পোর্টফোলিও এন্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট, এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এবং উত্তরা ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট। এদিকে বিএসইসি’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আইপিও ইস্যুতে কাজ করার চেয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট এবং আন্ডার-রাইটংয়ে বেশী আগ্রহী। কারণ আইপিও-তে কাজ করার ক্ষেত্রে সময় বেশি যায় এর পাশাপাশি দায়-দায়িত্বও অনেক বেশি। তাছাড়া আইপিও-তে অনেক শর্ত থাকায় অধিকাংশ কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী নয়। তাই আইপিওতে কাজ করতে না পারা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে এ বিষয়গওলোও বিবেচনা করা হবে।

অন্যদিকে, বিএসইসি’র এক প্রতিবেদনে উঠে আসে গত তিন বছরে সবচেয়ে বেশি আইপিও আবেদন জমা দিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের (আইসিবি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল। মার্চেন্ট ব্যাংকটি আলোচিত সময়ের মধ্যে ১৭টি আইপিও আবেদন জমা দিয়েছে। এরপরই রয়েছে জনতা ক্যাপিটাল, এএএ কনসালটেন্টস এন্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এএফসি ক্যাপিটাল, আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, ব্যাঙ্কো ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট, বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট, ফাস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট,

গ্রীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্ট, আইআইডিএফসি ক্যাপিটাল, লঙ্কা-বাংলা ইনভেস্টমেন্ট, এমটিবি ক্যাপিটাল, পিএলএফএস ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, সোনালী ইনভেস্টমেন্ট, সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিস এবং ট্রাস্ট ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট প্রত্যেকে গত তিন বছরে আইপিও আবেদন জমা দিয়েছে। বর্তমানে ৫৬টি মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৫২টি ফুল ফ্লেজড মার্চেন্ট ব্যাংকিংয়ের কাজ করছে। কমিশন সূত্রে জানা যায়, লাইসেন্সপ্রাপ্ত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে পাঁচ ধরনের কাজের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ইস্যু ম্যানেজমেন্ট বা কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধির ব্যবস্থাপনা। সুত্র: দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ