r n spiningশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি আরএন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের প্রধান রফতানি পণ্য অ্যাক্রিলিক সুতার চাহিদা কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে। দুই বছরে রফতানি ৪০ শতাংশ কমে লোকসানের দ্বারপ্রান্তে শতভাগ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি ও রাইট শেয়ার নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসই) সঙ্গে মামলা দীর্ঘদিনেও নিষ্পত্তি না হওয়ায় সংকট আরো তীব্র হয়েছে কোম্পানিটির। এদিকে আগামী বছর থেকে ১০ বছর মেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা শেষ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এতে কোম্পানিটির আর্থিক সংকট আরো বাড়বে।

কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী অ্যাক্রিলিকের চাহিদা কমে গেছে। বাংলাদেশের তুলনায় চীন ও ভিয়েতনামের পণ্যের দিকে বেশি ঝুঁকছেন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা।

ফলে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অ্যাক্রিলিক পণ্য রফতানি করতে পারছে না আরএন স্পিনিং। উত্পাদন হওয়ার পরও রফতানি করতে না পারায় গত দুই বছরে কারখানাতেই নষ্ট হয়েছে অনেক পণ্য। সংকটের মুখে দুই বছরের ব্যবধানে কোম্পানির মোট (গ্রস) মুনাফা ৯১ শতাংশের বেশি কমে গেছে।

আরএন স্পিনিংয়ের কোম্পানি সচিব মো. হান্নান মোল্লা বলেন, বিশ্বব্যাপী অ্যাক্রিলিক পণ্যের চাহিদা অনেকাংশে কমেছে। রফতানিতে আগের সফলতার কারণে দুই বছর আগে একসঙ্গে অনেক কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। তবে সে তুলনায় বিদেশীদের কাছ থেকে নতুন পণ্যের ক্রয়াদেশ পাওয়া যায়নি।

কাঁচামাল ফেরত দেয়া সম্ভব না হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন ফেলে রাখলে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় পণ্য উত্পাদন করা হয়েছে। কিন্তু রফতানি তথা বিক্রি কমে গেছে। এদিকে উত্পাদনের পর কাঙ্ক্ষিত রফতানি না হওয়ায় তা কোম্পানির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

আরএন স্পিনিংয়ের গত দুই বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, শতভাগ রফতানিমুখী আরএন স্পিনিং মূলত ১৬ ধরনের অ্যাক্রিলিক ও দুই ধরনের কটন সুতা উত্পাদন করে থাকে। আগের বছরগুলোয় কোম্পানির উত্পাদন ও রফতানি ধারাবাহিক থাকলেও ২০১৪ সাল থেকে তাদের রফতানিতে ধস নামে।

২০১৪ ও ২০১৫ সাল মিলিয়ে রফতানি কমেছে ৪০ শতাংশের বেশি। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির মোট পণ্য রফতানি ছিল ৩৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকার, ২০১৫ সালে যা ২৩২ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। পণ্য বিক্রি কমলেও এর বিপরীতে উত্পাদন খরচ না কমার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কোম্পানির মোট মুনাফায়।

একদিকে কোম্পানির উত্পাদিত পণ্য বিক্রি যেমন কমছে, অন্যদিকে উত্পাদন খরচ ও পরিচালন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালে বিক্রীত পণ্যের বিপরীতে কোম্পানির উত্পাদন ব্যয় ছিল ২৪৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট টার্নওভারের ৬৪ শতাংশ।

আর পণ্য উত্পাদন করে বিক্রি করতে না পারায় ২০১৫ সালে টার্নওভরের বিপরীতে উত্পাদন খরচ দাঁড়ায় ৯৫ শতাংশে। দুই বছরের ব্যবধানে কোম্পানির পরিচালন ব্যয় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে ২০১৫ সালে কোম্পানিটি নামমাত্র মুনাফায় থাকে। তবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এসে লোকসান দেখিয়েছে তারা।

নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে আরএন স্পিনিংয়ের মোট মুনাফা ছিল ১৩৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে যা মাত্র ১২ কোটি ৯ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। ২০১৪ সালে মোট মুনাফা ছিল ৪৯ কোটি ৭ লাখ টাকা। এদিকে কোম্পানির মোট মুনাফা কমে যাওয়ার পাশাপাশি পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নিট মুনাফায়ও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে সরকারের কর অবকাশ সুবিধা পাওয়া এ কোম্পানির।

২০১৩ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ১৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে যা মাত্র ৫ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। প্রেফারেন্স শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ বাদ দেয়ার পর নিট মুনাফা কমে ১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় নেমে আসে।

চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানিতে উন্নতি না হলেও আরএন স্পিনিংয়ের উত্পাদন ও পরিচালন ব্যয় আরো বেড়েছে। এতে লোকসানে পড়েছে কোম্পানিটি। ২০১৬ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা গ্রস লোকসান ও শেয়ারপ্রতি ৪৯ পয়সা নিট লোকসান দেখিয়েছে এ কোম্পানি। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আলোচিত সময়ে এর কোম্পানির উত্পাদন খরচ ৪০ দশমিক ২৬ শতাংশ ও পরিচালন ব্যয় ৩৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেড়েছে।

কোম্পানির পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া ও মুনাফা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে কোম্পানি সচিব বলেন, মূলত কারখানার বর্তমান মেশিনারি পুরনো হয়ে যাওয়ায় উত্পাদন খরচ বেড়ে গেছে। অ্যাক্রিলিক পণ্য ছেড়ে সাধারণ সুতা উত্পাদনে জোর দেয়ার পরিকল্পনা থাকায় জনবল কমানো হয়নি।

আর অ্যাক্রিলিকের নতুন মেশিনারিও আমদানি করা হচ্ছে না। ফলে রফতানির তুলনায় উত্পাদন ও পরিচালন ব্যয় বেশি বেড়েছে। কটন সুতা উত্পাদনের জন্য নতুন ভবন স্থাপন ও প্রয়োজনীয় মেশিনারি আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। তা সম্পন্ন হলে আশা করছি সব সমস্যা কেটে যাবে। এদিকে রাইট শেয়ার-সংক্রান্ত মামলার কারণে চার বছর ধরে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করতে পারেনি কোম্পানিটি। এ কারণে কোনো লভ্যাংশ পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আরএন স্পিনিংকে বিদ্যমান একটি শেয়ারের বিপরীতে একটি হারে রাইট ইস্যুর অনুমোদন দেয় বিএসইসি। ১০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে ওই সময় সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে কোম্পানিটি।

তবে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার কেনার বিষয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নেন তারা। কোম্পানির পরিচালকরা রাইট শেয়ারের জন্য কোনো টাকা জমা না দিয়েই ব্যাংকের জাল কাগজপত্র জমা দিয়ে বিএসইসিকে জানায়, তারা ওই শেয়ার কিনেছে। পরবর্তীতে বিএসইসির অনুসন্ধানের জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আরএন স্পিনিংয়ের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি, হস্তান্তর, বন্ধক ও উপহার দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

পরবর্তীতে বিএসইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যায় আরএন স্পিনিং। আদালত বিএসইসির সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করলে পাল্টা মামলা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও। পাল্টাপাল্টি মামলার ফলে দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে এ কোম্পানির এজিএম এবং লভ্যাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত।