atm boothশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশে জুড়ে সাড়ে ৬ হাজার অবৈধ অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম বুথের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এইসব অবৈধ এটিএমের একটা বড় অংশ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়েছে কম্পিউটার যন্ত্রাংশের কথা বলে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এনবিআরের হিসাবে নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করে এখন পযর্ন্ত দেশে এটিএম আনা হয়েছে মাত্র ৯৩৩টি। এর বাইরে সাড়ে ৬ হাজার এটিএম আনা হয়েছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে কম্পিউটার যন্ত্রাংশের কথা বলে। অবশ্য স্যাম্পলের নাম করেও আনা হয়েছে কুরিয়ারে।এর ফলে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, দেশে যে পরিমাণ এটিএম মেশিন আনা হয়েছে তার অধিকাংশই এসেছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে।  প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে,মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব এটিএম মেশিন আমদানি করা হয়েছে।

তবে আমদানি প্রক্রিয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হতে আরও সময় লাগবে। সবকটি আমদানিকারকের তথ্য-উপাত্ত হাতে আসার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ি, সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার এটিএম বুথ ব্যবহার করেন গ্রাহকরা।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটা সত্য যে, খুবই অল্প এটিএম আনা হয়েছে ঘোষণা দিয়ে। আর বাকি এটিএমগুলো হয়ত এনবিআরকে ফাঁকি দিয়ে কম্পিউটার যন্ত্রাংশের কথা বলে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এনবিআর যে হিসাবটা বলছে সেটা সঠিক,তবে আমরাও কিন্তু নিয়মকানুন মেনেই এটিএম স্থাপন করেছি’।

এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দাদের তদন্ত অনুযায়ী, শুল্ক ফাঁকি দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলো কমদামি ও নিম্নমানের এটিএম বেশি স্থাপন করেছে। অনেক ক্ষেত্রে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ দেখিয়ে এটিএম মেশিন আমদানি করা হয়েছে। এর আগে শুল্ক ফাঁকির বিষয়ে এটিএম মেশিন ব্যবহারকারী সব ব্যাংক এবং এটিএম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে (এমডি) এ বিষয়ে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

ওই চিঠিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আমদানিকৃত এটিএম মেশিন সংখ্যা, তাদের ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর, বাজার দর সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয়। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো তথ্য সরবরাহ করলেও দেশের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক ‘টেকনোমিডিয়া লিমিটেড’ তথ্য প্রদানে দুই মাস সময় চেয়েছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে যে পরিমাণ এটিএম মেশিন ব্যবহার হয়ে থাকে তার অর্ধেকই টেকনোমিডিয়ার আমদানি করা। এই প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা মেশিনগুলোর অধিকাংশের শুল্ক  পরিশোধ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন শুল্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা।

জানা গেছে, এটিএম মেশিন আমদানি করতে বর্তমানে শুল্ক দিতে হয় ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ আমদানিতে কোনও শুল্ক লাগে না। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েই কম্পিউটারের নামে এটিএম আনার তথ্য পেয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।  সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে এটিএম বুথে অর্থ জালিয়াতির ঘটনাটি আলোচিত হলে মেশিন আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দাদের সন্দেহ হয়। এর পর দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

চিঠির জবাবে ব্যাংকগুলো জানায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকে হাঙ্গেরি, চিন, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি মেশিন ক্রয় করে। তবে আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যাংকগুলো জড়িত নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম এটিএম নিয়ে আসে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। বর্তমানে এই ব্যাংকের মোট এটিএম বুথ ৮৩টি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বুথ সংখ্যা এখন ৫ হাজারেরও বেশি। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের বুথ সংখ্যাও ২শ’র ওপরে।

৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ছাড়া সব ব্যাংকই কমবেশি এটিএম বুথ চালু করেছে। দেশজুড়ে সাড়ে ৭ হাজার এটিএম বুথ থেকে প্রায় ১ কোটি গ্রাহক কার্ডের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশে যেসব এটিএম মেশিন ব্যবহার হয়ে আসছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর মেশিনের সংখ্যা ৪ হাজার ৭শ ৭৩টি, জার্মানির উইনকোর মেশিনের সংখ্যা ২৫০০ এবং অন্যান্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মেশিনের সংখ্যা ৪০০।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর করপোরেশনের এটিএম মেশিনের দাম ১০ লাখ টাকার বেশি হলেও ব্যাংকগুলো মাত্র ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার নিম্নমানের এটিএম মেশিন বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছে। এ কারণে এসব মেশিন সহজেই ক্লোন করতে পারছে জালিয়াত চক্র।
জানা গেছে, চীনের তৈরি একটি এটিএম আমদানি করতে ৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর করপোরেশনের এটিএম কিনতে লাগে ১০ লাখেরও বেশি টাকা।

অথচ মাত্র ৬ লাখ টাকাতেই এটিএম স্থাপন করেছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো। কম দামে ব্যাংকগুলোকে এই এটিএম সরবরাহ করেছে টেকনোমিডিয়া লিমিটেড ও ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালট্যান্টস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমসের মাধ্যমে ৬০৪টি এটিএম আমদানি হয়েছে।এর মধ্যে ৬০৩টিই আমদানি করেছে ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালট্যান্টস লিমিটেড।

এ প্রসঙ্গে ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালট্যান্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাইফুদ্দিন মুনির বলেন, আমরা প্রত্যেকটি এটিএম হিসাবেই এলসি করে এনেছি। এর ডকুমেন্ট আমাদের কাছে যেমন আছে, ব্যাংকের ও কাস্টমসের কাছেও আছে। ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালট্যান্টস ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার এটিএম আমদানি করেছে বলেও জানান তিনি।