salmanশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: শেয়ার কেলেংকারি মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে প্রধান সারিতে রয়েছেন দেশের তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তারা হলেন শাইনপুকুর হোল্ডিংস ও দোহা সিকিউরিটিজের শেয়ার কেলেংকারিতে জড়িত আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের শেয়ার কেলেংকারিতে জড়িত ব্যাংক এশিয়া ও র‌্যাংগস গ্রুপের চেয়ারম্যান এ রউফ চৌধুরী এবং ওয়ান ব্যাংক ও এইচআরসি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাঈদ হোসেন চৌধুরী।

এ ছাড়া প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের মামলায় আসামি হিসেবে নাম রয়েছে ব্যাংক এশিয়ার অপর পরিচালক মসিউর রহমানের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, একটি মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর উচ্চ আদালতের আদেশে তা স্থগিত হয়ে যায়। অপর দুটি মামলা কোয়াসমেন্টের (চলতে পারে না মর্মে বাতিল করা) জন্য আবেদন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সালমান এফ রহমান যুগান্তরকে বলেন, তার দুটি মামলাই সম্প্রতি কোয়াসমেন্ট করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর ফলে তাকে কেলেংকারিতে অভিযুক্ত আর বলা যাবে না।

বাদীপক্ষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনজীবী মাসুদ রানা খান বলেন, কোয়াসমেন্টের কাগজপত্র তারা পাননি। শেয়ারবাজার সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনালেও এ ধরনের কাগজপত্র আসেনি। কাগজপত্র পেলে তারা হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আর্থিক খাতের দুটি অঙ্গ- মুদ্রা এবং পুঁজিবাজার। এর মধ্যে কেউ একটি খাতে কেলেংকারি করলে তাকে অন্য খাতের নেতৃত্বে আসতে দেয়া মোটেই উচিত নয়। আসা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত ও নীতিগত বিষয় হতে পারে না। কেননা এ শ্রেণীর লোক শুধু ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেন।

এদিকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিরুদ্ধে স্ববিরোধী অবস্থান নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা একদিকে উল্লিখিত তিন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেংকারি মামলার বাদী অপরদিকে তাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য অনাপত্তি পত্রও দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি সম্পূর্ণ স্ববিরোধী অবস্থান। কেননা, নিয়ম রয়েছে যারা শেয়ার কেলেংকারিতে অভিযুক্ত তারা কোনোভাবেই মুদ্রাবাজারে আসতে পারবেন না।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতের দুটি অঙ্গ- মুদ্রা এবং পুঁজিবাজার। এর মধ্যে কেউ এক খাতে লুটপাট করলে অন্য খাতের কোনো কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে অনুমোদন দেয়া উচিত নয়। এটি ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, প্রথমত. এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত. নৈতিকতা থাকলে উনারা নিজে থেকেই সরে যেতে পারেন। না হলে ব্যাংক খাতেও এ রকম কেলেংকারির আশংকা থাকে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। রায়ে কোনো ধরনের শাস্তি হলে তাদের আর থাকার অধিকার নেই। তারা সবাই পদ হারাবেন।

শাইনপুকুর হোল্ডিংসের মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৬ সালে দু’দফায় শাইনপুকুর হোল্ডিংসের পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে ২৫২ কোটি টাকা করা হয়। এতে প্রথম দফায় ২৫০ কোটি এবং পরবর্তীকালে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে আরও ২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। নিয়মানুসারে প্রথম দফায় শাইনপুকুর সিরামিকসের ২৫০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের পুরোটাই বিনিয়োগ হওয়া উচিত। কিন্তু তদন্ত কমিটি ১৪৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে। আর আমেরিকান এক্সপ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ১৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে।

এই এফডিআরের টাকা বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হলেও বিনিয়োগ আসে মাত্র ১৬৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এরপরও ঘাটতি থাকে প্রায় ৮৭ কোটি টাকা। এই টাকার কোনো হিসাব দিতে পারেননি কোম্পানির উদ্যোক্তারা। ফলে উদ্যোক্তাদের এই অবস্থান যুক্তিসঙ্গত নয়। এরপর নাম পরিবর্তন করে ১২৫টি রাইট শেয়ার ইস্যু করে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন আরও ২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, এ ধরনের কাজ অভিনব এবং অস্বাভাবিক যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশের ১৭ ধারার লংঘন।

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর হোল্ডিংসের শেয়ারে কারসাজি করে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সালমান এফ রহমানসহ প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। ১৯৯৬ সালের ৩০ জুন শাইনপুকুর হোল্ডিংসের শেয়ারের দাম ছিল ৭৩ টাকা।

এরপর কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির দাম বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির পক্ষ থেকে ভুয়া কিছু মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। এরপর ৫ মাসের ব্যবধানে ১৯৯৬ সালের ২৮ নভেম্বর শেয়ারটির দাম ৭৩ টাকা থেকে ৭৫৪ টাকায় উন্নীত হয়। এ হিসাবে ৫ মাসে দাম বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।

আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ৫১ লাখ ৬৬ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ফরেন ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্টের (ডিভিপি) মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি হয়েছে। এর বেশিরভাগ শেয়ার লেনদেন হয়েছে দোহা সিকিউরিটিজ নামে একটি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় করেছে ৭ লাখ ৬০ হাজার শেয়ার এবং নিজের পোর্টফোলিওতে রাখা শেয়ারসহ বিক্রি করেছে ২৩ লাখ ৭ হাজার শেয়ার।

রিপোর্টে বলা হয়, এই কোম্পানিটি বেক্সিমকো গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে এ সময়ে কোম্পানির উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে অনেক তথ্য গোপন করেন। এরপর শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

জানতে চাইলে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বলেন, ‘আমরা এখন আর অভিযুক্ত নই। সম্প্রতি আমাদের মামলাটি কোয়াস করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন আমাদের অভিযুক্ত বলা যাবে না। ফলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই।’

এ প্রসঙ্গে বিএসইসির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা খান বলেন, ‘কোয়াসের কোনো কাগজপত্র তারা পাননি। আর হাইকোর্ট থেকে কোয়াস করা হলেও এখনও আপিল বিভাগ রয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র পেলে আপিল করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘তাদের কারসাজির বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার। যা আমরা আদালতে প্রমাণ করব।’

অপর মামলা প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের কেলেংকারি। এ মামলায় অন্যতম আসামি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ র‌্যাংগস ও ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রউফ চৌধুরী, ব্যাংক এশিয়ার পরিচালক মসিউর রহমান, এইচআরসি গ্রুপ এবং ওয়ান ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাঈদ হোসেন চৌধুরী। মামলা সূত্রে জানা গেছে, আসামিরা প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের নামে ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন।

এ সময়ে তারা মিতা টেক্সটাইল, প্রাইম টেক্সটাইল, বাটা সুজ ও বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার লেনদেন করেন। প্রতিষ্ঠানটি ওই সময়ে মোট ১২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা লেনদেন করে। এর মধ্যে শুধু ফরেন ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্টের (ডিভিপি) মাধ্যমে ৮৫ লাখ টাকা লেনদেন করে। ১ নম্বর আসামি রউফ চৌধুরী ওই সময়ে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩টি শেয়ার বিক্রি করেন। যার মূল্য ছিল ৬৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

স্টক এক্সচেঞ্জের রেকর্ড অনুসারে আসামিরা এসিআইর ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮১৯টি শেয়ার বিক্রি করেন। অথচ ব্যাংক রেকর্ড অনুযায়ী শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৮টি। এর মধ্যে ফরেন ডিভিপির মাধ্যমে লেনদেন অনিষ্পত্তি হওয়া শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

একইভাবে আসামিরা ডিভিপির মাধ্যম ছাড়াও স্থানীয়ভাবে শেয়ারের অন্যতম ক্রেতা-বিক্রেতা ছিলেন। আসামিরা ওই সময়ের মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মার ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৯৫টি শেয়ার বিক্রি করেন। এর মধ্যে ডিভিপির মাধ্যমে ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০টি শেয়ার বিক্রি করেন। আর এখানেও অনিষ্পত্তি হওয়া শেয়ার ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫০০টি। এসব ফরেন ডিভিপির মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠানটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও ইন্দোসুয়েজ ব্যাংক ব্যবহার করত।

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ওই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে আসামিদের অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মামলা করে বিএসইসি।
মামলার বাদী বিএসইসি। অথচ ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য বিএসইসির অনাপত্তি লাগে।

জানতে চাইলে নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকের পরিচালকদের আমরা অনুমতি দেই না। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপার। তবে আমি যতদূর জানি স্বতন্ত্র পরিচালক হলে অনুমোদন নিতে হয়। এর বাইরে কিছু বলতে হলে আইনটি জেনে বলতে হবে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  বলেন, বিষয়টি নৈতিকতার। কারণ পুঁজিবাজারে কেলেংকারি করলে মুদ্রাবাজারে যাওয়া যায় না। তার মতে, এই চেয়ারম্যানদের নিয়োগে বিএসইসি নৈতিকভাবে আপত্তি দিতে পারত।

তবে সবার নৈতিকতার মানদণ্ড এক নয়। তিনি বলেন, সরকারের অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক সময় আপত্তি দিলেও টিকে থাকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি দিয়েছিল। কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা বলেন, ‘পরিচালকসহ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই পোর্টফোলিও (ব্যক্তিগত পদের পরিচয়) চেক করা হয়। তবে এদের ক্ষেত্রে কী করা হয়েছে এবং আইনে কী আছে তা আমার জানা নেই। বিষয়টি জেনে পরে জানানো যাবে।’

এদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১১ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে তাকে অপসারণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুগান্তর