বনসাই তৈরীতে ১০০ টাকার বিনিয়োগে ২৪ বছরে এখন কোটি টাকায়!
শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি বাড়তি আগ্রহ ছিল বনসাই শিল্পী কে এম সবুজের। ১৯৯৬ সালে সিলেটে গিয়ে এক নার্সারিতে একটি বনসাই দেখেন। সেখান থেকে কয়েকটি চারা কিনে শুরু করেন বনসাই চাষ। এখন তার বাগানে এক হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের বনসাই আছে।
এরই মধ্যে তার সৃজন বনসাইয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে মালয়েশিয়া ও ভারত। রপ্তানি হচ্ছে অন্তত ২০ লাখ টাকার বনসাই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী যুবকরা বনসাই সংগ্রহের পাশাপাশি বেকারত্ব ঘোচাতে নিচ্ছেন নানা প্রশিক্ষণ। এ বনসাই শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান ও মোটা অংকের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন হবে বলে জানান সবুজ।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চর পাথালিয়া গ্রামের সরকারি চাকরিজীবী কেএম সবুজ। পুরো নাম খান মুহাম্মদ সবুজ। থাকেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আমবাগ পশ্চিমপাড়া এলাকায়। সেখানেই এক বিঘা জমিতে তার স্বপ্নের বনসাইয়ের বাগান। তার বনসাই বাগানে গাছের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বনসাই তৈরি করছেন।
তার হাতে তৈরি লাখ লাখ বনসাই ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে। বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে ছাদেও রয়েছে দুই হাজারের বেশি বনসাই। সবুজের বনসাইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে মালয়েশিয়া ও ভারতে। ইতিমধ্যে আম, জাম, ডালিম, আমড়া, বরই, কদবেল, বাবলা, তেতুল, কৃষ্ণচূড়া, বাবলা ও নিমগাছসহ বেশ কিছু বনসাই গাছ বিক্রি করেছেন একটি মালয়েশিয়ার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
সবুজের মাত্র ১০০ টাকার বিনিয়োগ ২৪ বছরে এখন এক কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তার কাজে স্ত্রী, মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই সহযোগিতা করেন। দিন দিন বাড়ির ছাদ ছাড়াও জমিতে বনসাই বাগান সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বাগানে কাজ করছেন ১২ জন শ্রমিক। বেশ কয়েকটি একক বনসাই প্রদর্শনীতে তার বনসাই আলোচিত হয়। ইতোমধ্যে পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পদক।
সবুজ প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ টাকার বনসাই ভারত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেন। তিনি বলেন, তার রপ্তানি করা বনসাই গাছ ক্রেতারা প্রথমে তার কাছ থেকে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যান। সেখানে বনসাইগুলো জাহাজে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে স্কচটেপে বিশেষভাবে মুড়িয়ে টবে রাখা হয়। পরে গাছগুলো জাহাজ থেকে নামিয়ে হরমোন দিয়ে ফের টবে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে বনসাই থেকে নতুন পাতা গজায়।
শুরুর গল্প: ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে। সিলেট শহরে এক নার্সারিতে একটি বনসাই দেখেন তিনি। সেটার প্রেমে পড়ে যান সবুজ। বাসায় ফিরে ভাইয়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে চারটি তেঁতুলের চারা কিনে বনসাই চর্চার যাত্রা শুরু করেন। ২০০৭ সালে তিনি প্রাতষ্ঠানিকভাবে প্রখ্যাত বনসাই শিল্পী নাজমুল হাসানের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে চীনে এবং ২০১৮ সালে মালেয়শিয়া ও সিঙ্গাপুরে বনসাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন সবুজ।
পৈতৃক ভিটা গজারিয়া হলেও তার পুরো পরিবার ঢাকায় থাকে অনেক আগে থেকেই। উত্তরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি একসময় বাসার ছাদ, বারান্দা ও আঙিনা নিজের করা বনসাইয়ে ভরে যায়। প্রথমে কয়েক বছর তিনি লাভবান হতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে ১০-১২ বছর চলে যায়। পরিবারের সদস্যরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন একসময়। পরিবার থেকে একপর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি।
ঠিক সে সময়টাতে একটা বনসাই ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরিবারের কাছে আবার ফিরে যান। তাদের কাছে বেড়ে যায় সবুজের কদরও। বড় পরিসরে নতুনভাবে শুরু করেন বনসাই উৎপাদন। এরই মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে ফেলেন।
প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ঢাকা, মালয়েশিয়া রেডিয়েন্ট, ভারতের সার্ক কালচার ও চীনের ঘুঞ্জু লায়ান ডিস্ট্রিক নার্সারি এবং সিঙ্গাপুরের চায়না গার্ডেন থেকে। উদ্যোক্তা কেএম সবুজ জানান, শখের বশে বনসাই করা শুরু হলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে বনসাই বিক্রি করে ভালো আয় হচ্ছে তার। নতুন সম্ভাবনাময় বনসাই শিল্প তরুণদের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে। তার বনসাই বাগানে ৪৫০ প্রজাতির ২০ হাজারের বেশি বনসাই রয়েছে।
প্রতি বছর ভারত ও মালয়েশিয়ায় ২০ লাখ টাকার বনসাই রপ্তানি করা হয় এবং দেশে অন্তত ২৫ লাখ টাকার বনসাই বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডেকোরেশনের কাজে এবং সৌখিন লোকজন তার বনসাই কিনছেন। বনসাইয়ের পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন দুটি বড় আকারের নার্সারি। সব মিলিয়ে এখন কোটি টাকার ওপর মূলধন রয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর ২০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বৃক্ষ সংরক্ষণ, উদ্ভাবন ও গবেষণা ক্যাটাগরিতে তাকে পুরস্কার প্রদান করেন। সবুজ বলেন, ছোট আকৃতি হওয়ায় বনসাই বাসা-বাড়ির যেকোন জায়গায় মানানসই। সবুজের কাছে থেকে সময় কাটানোর আগ্রহ থেকেই কর্পোরেট হাইজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কদর বেড়েছে বনসাই।
তবে বাড়িতে আগ্রহী যে কেউ নিজেই এই শৈল্পিক বনসাই তৈরি করতে পারবে। এ জন্য কিছু নিয়ম ও কলাকৌশল জানতে হবে। আর এসব কলাকৌশল রপ্ত ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বনসাই তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন তরুণ ও উদ্যোক্তারা। দেশে যুব মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি প্রশিক্ষণের সঙ্গে বনসাই জুড়ে দিলে দেশে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, বনসাই নিয়ে সরকারের কোন নীতিমালা নেই। সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই দেশে চলছে বনসাই শিল্প। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকায় বনসাইয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বনসাই শিল্পী। ইউরোপেও বনসাইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বনসাই রপ্তানিতে সরকারি সহায়তা পেলে এ শিল্প বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে একটা গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
ইতোমধ্যে তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় হাজার খানেক বনসাই তৈরি করেছেন সালনা এলাকার তসলিম নামে এক যুবক। এছাড়া সারা দেশেই যুবকদের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে বনসাই উৎপাদন ও প্রশিক্ষণের নিয়ম কানুন। সবুজের কাছ থেকে বনসাইয়ের কলাকৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী তসলিম বলেন, প্রায় এক বছর কেএম সবুজ সাহেবের কাছে বনসাই নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছি।
শুরুতে বনসাই তৈরির কলাকৌশল রপ্ত করি। পরে ফাইকাস (বট) জাতীয় বৃক্ষ নিয়ে বনসাই করা শুরু করি। বর্তমানে আমার এখানে ৬ শতাধিক বনসাই রয়েছে যার মধ্যে আছে ১০৩ প্রজাতির ফাইকাস। এরই মধ্যে বনসাই তৈরিতে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় করেছি, গাছগুলোর যত্ন নিচ্ছি। বর্তমানে আমার বাগানের বনসাইগুলোর বয়স চার বছর, আর কিছু দিন গেলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বনসাই বিক্রি শুরু করবো।
বনসাই নিয়ে সন্তষ্ট ক্রেতারা: কেএম সবুজের বনসাই নিয়ে আগ্রহ রয়েছে দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের। সুস্থ সবল গাছ, সতেজ ও রোগমুক্ত পাতা এবং ক্রেতাদের ঘরে বনসাই রাখার নানা নিয়ম কানুন নিজেই বলে দেন সবুজ। আর এতে সন্তুষ্ট তার ক্রেতারা। ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা বনসাই ক্রেতা মো. মোশতাক বলেন, আমার অত্যন্ত পছন্দ বিভিন্ন বনসাই চারা।
এরই মধ্যে আমি কেএম সবুজের কাছ থেকে ১০টি বনসাই নিয়েছি যেগুলো তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। এর মধ্যে বট এবং ফোকেনটি নামের দুটি বনসাই আমি নিজের বাসার জন্য রেখেছি এবং বাকি বনসাই বিভিন্ন জনকে উপহার দিয়েছি। তার উৎপাদিত বনসাই বেশ সতেজ, সুস্থ এবং সবল। এ গাছগুলো সহজে মরে না, তাই গাছগুলো নিয়ে আমি বেশ খুশি। দেশের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে বনসাই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখারা পাশাপাশি শহুরে নাগরিক জীবনে আনতে পারে স্বস্তির পরশ এমনটাই দাবি করছেন বনসাই শিল্প সংশ্লিষ্টরা।