sharebazer lagoশরিফুল ইসলাম পলাশ : ব্যাংকিং খাতে সাইবার আক্রমণের পর দেশের আর্থিক খাতের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুঁজিবাজারের ত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারীসহ লেনদেনের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে আগাম সতর্কতার তাগিদ সাইবার নিরাপত্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের।

আর্থিক খাতের সম্পদের সুরক্ষায় প্রয়োজনে সাইবার বীমার বিষয়ে নজর দেয়ারও তাগিদ দিচ্ছেন তারা। তবে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষেত্রগুলোতে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মুখপাত্র।

অনুসন্ধানে মিলেছে, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে গোপন সুইফট কোড ব্যবহার করে ফান্ড ট্রান্সফার অ্যাডভাইজ পাঠানোর মাধ্যমে ফিলিপাইন ৮১ মিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কায় ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরিয়ে নেয়া হয়। এজন্য সাপ্তাহিক ও নববর্ষ মিলিয়ে চারদিনের ছুটিকে কাজে লাগিয়েছে অর্থ লুটকারীরা।

২৯ ফেব্রুয়ারি এই লুটের তথ্য ফাঁস করে ফিলিপাইনের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ইনকোয়ের’। ৭ মার্চ বিদেশি গণমাধ্যমের বরাতে দেশীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের আগ পর্যন্ত বিষয়টি গোপনই ছিল। ঘটনা ফাঁসের পর দেশের আর্থিক খাতে এক ধরনের টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবীর। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলমকে ওএসডি করা হয়েছে।

সেইসঙ্গে ঘটনার তদন্তে সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে গতকাল মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলার তদন্তভার সিআইডির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।

হ্যাকিং প্রলয়ে বড় ধরনের অস্থিরতা চলছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে। দেশের পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতও সাইবার আক্রমণের ঝুঁকির বাইরে নয় বলে মনে করছেন তথ্য-প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। প্রযুক্তিবিদ ও ফাইবার অ্যাট হোমের চিফ স্ট্যাটেজিক অফিসার সাবির আহমেদ সুমন বলেছেন, ‘দেশের আর্থিক খাত সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে এটা নতুন করে বলার কিছু নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনায় সেই দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এখন দেশের আর্থিক খাতের নিরাপত্তার দিকে জোর দিতে হবে। প্রত্যেকটি সেক্টরেই বিদ্যমান সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে, সেই ব্যবস্থাকে হালনাগাদ ও ত্রুটিমুক্ত করার দিকে জোর দিতে হবে’।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেছেন, ‘পুঁজিবাজার তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর একটি বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখন সিডিবিএল, ডিএসইম সিএসই ও বিএসইসির কাছে দৈনন্দিন লেনদেনের তথ্যসহ বহু ধরনের তথ্য রয়েছে। সেই তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির তথ্যও জালিয়াত চক্রের হাতে চলে না যায় সে জন্য ব্যবস্থা আছে। সেই ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি আছে কিনা সেটি দেখতে হবে’।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে সাইবার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল সিকিউরিটিজের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত থাকে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপর্যয়ের পর আমরা যার যার জায়গা থেকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। প্রযুক্তিনির্ভরতা থাকলে সেখানে ঝুঁকিও থাকবে। সেই ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য সব সময়েই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আশা করছি, আমাদের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ওপর নজর দেবে’।

অন্যদিকে, সাইবার ঝুঁকি থেকে সম্পদ নিরাপদ রাখতে সাইবার বীমার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেছেন, ‘তথ্য-প্রযুক্তির থাকলে সেখানে ঝুঁকিও থাকবে। সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রেখে ঝুঁকি কমানোর ওপরেই আর্থিক সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে দৃষ্টি দিতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তিজনিত বিপর্যয়ের কারণে সম্পদহানি এড়াতে উন্নত বিশ্বে সম্পদের বিপরীতে সাইবার বীমা করা হয়। আমরাও বিষয়টি ভেবে দেখতে পারি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি সম্পদের বীমা থাকলে ঝুঁকি মোকাবেলা অনেক সহজ হবে’।

সাইবার বীমা বিষয়ে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা চৌধুরী বলেছেন, ‘সাইবার নিরাপত্তার জন্য বীমা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক কোম্পানির সম্পদের সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। সেই ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়েই সাইবার বীমার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে সাইবার আক্রমণের ক্ষতি মোকাবেলায় বীমা চালু করা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনার পর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি’।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক এম সাইফুর রহমান বলেছেন, ‘পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক। এ বিষয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করে সেই কমিটির সুপারিশ মেনে ইতোমধ্যেই সিডিবিএলের সাইবার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু মনিটরিং করা হচ্ছে, এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে’। সুত্র: শেয়ার বিজ