শ্যামপুর সুগারের বিনিয়োগকারীরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত
আফজাল হোসেন লাভলু, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি শ্যামপুর সুগারের বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরে মুল পুঁজি নিয়ে দু:চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। বছরের পর বছর লোকসানের অজুহাতেই বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমানে কারসাজির আরেক নাম ‘‘নো ডিভিডেন্ড’’ (কোনো লভ্যাংশ নয়)। ফলে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর এ প্রতারণা করেন খোদ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকরা। কোম্পানিগুলোর কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় তারা এ সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুঁজিবাজারে ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি মানেই লোকসান। এ লোকসানের অজুহাতেই বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করা হয়। আর সেই প্রতিষ্ঠান যদি হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানার, তাহলে সেখান থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। দূরদর্শিতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবে দিন দিন লোকসানের বোঝা ভারী হয় কিন্তু কোম্পানির অবস্থা পরিবর্তনের দিকে কর্তৃপক্ষের নজর থাকে না।
যে কারণে সম্ভাবনা থাকলেও এ কোম্পানিগুলো লোকসানের কবল থেকে মুক্ত হতে পারে না। এমন তথ্যে মিলেছে ‘জেড’ ক্যাটাগরির শ্যামপুর চিনিকলের লোকসানের কারণ অনুসন্ধানে।
রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো প্রকার ডিভিডেন্ড দেয়নি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সরকারের উদাসীনতার কারণে এ সময়ে প্রায় ২৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের মুখে পড়েছে। ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এ খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটির সম্ভাবনা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৬৪ সালে ৬৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে শ্যামপুর সুপার মিলস গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এজন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রংপুর জেলার বদরগঞ্জে ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে।
প্রায় আড়াই বছর ১৯৬৬-৬৭ আখ মাড়াই মৌসুমে প্রথম কাঁচামাল আখ থেকে চিনি উৎপাদন শুরু করে ১০ হাজার ৬১ মেট্রিক টান চিনি উৎপাদন ক্ষমতার এ চিনিকলটি। উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১২-১৩ মাড়াই মৌসুম পর্যন্ত ৪৩ মাড়াই মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১২ মৌসুমে লাভের মুখ দেখেছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৯৭৬-৭৭ মাড়াই মৌসুমে ১০২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, ১৯৭৭-৭৮ মাড়াই মৌসুমে ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ১৯৭৮-৭৯ মাড়াই মৌসুমে ৫৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ১৯৭৯-৮০ মাড়াই মৌসুমে ১৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ১৯৮০-৮১ মাড়াই মৌসুমে ১৭৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা লাভ করেছে। এ সময়ের মধ্যে ১৯৮১-৮২ মাড়াই মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা লাভ করেছে।
১৯৮২-৮৩ মাড়াই মৌসুম থেকে ১৯৯৪-৯৫ মাড়াই মৌসুম পর্যন্ত আরো ৬২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা লাভ করেছে। ১৯৯৬ সালে লোকসানের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে শেয়ার ছেড়ে দেয়া হয় এ প্রতিষ্ঠানটি। ৫০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের প্রতিষ্ঠানটির ৫০ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারি মালিকানায় রেখে বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়।
এরপর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ৩১টি মাড়াই মৌসুমে লাভের মুখ দেখেনি। সর্বশেষ, শ্যামপুর সুগার মিলসের পুঞ্জীভূত লোকসান প্রায় ১৭৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনোপ্রকার ডিভিডেন্ড দেয়নি।
ডিএসই সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শ্যামপুর সুগারের শেয়ার এর আগের সপ্তাহের সর্বশেষ কার্যদিবসে ৬ টাকায় লেনদেন হয়েছে। আর বিগত এক বছরে এ কোম্পানির শেয়ার দর ৫.৮০ টাকা থেকে ৮.১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে। জুন ক্লোজিংয়ে কোম্পানিটির দ্বিতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ৬৭.৩৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৬.০৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত লোকসানে রয়েছে শ্যামপুর সুগার।
অন্যদিকে, ‘জেড’ ক্যাটাগরির এ কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকার বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন ৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে পুঞ্জীভূত লোকসান রয়েছে ২৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বর্তমানে এ কোম্পানির ৫২.১৬ শতাংশ শেয়ার সরকারের হতে এবং ৪৭.৮৪ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কাঁচামাল আখ সঙ্কট, কারখানার যান্ত্রিক ত্রুটি, সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাব, উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া ও কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তিন দশকেও প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে শেষ কথা বলার সময় আসেনি, বরং সময়োপযোগী পদক্ষেপ এ প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করতে পারে- বলে মত দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
দায়িত্বশীলদের মতে, আখচাষিদের হয়রানি, আখ ক্রয়ে দুর্নীতি ও আখের মূল্য কম হওয়ার কারণে চাষিরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কাঁচামাল আখ সঙ্কটের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিনি উৎপাদিত হচ্ছে না। চাষি হয়রানি কমিয়ে আখের উপযুক্ত মূল্য প্রদান ও উন্নত জাতের আখ চাষ করা গেলে আখ সঙ্কট কমানো সম্ভব হবে।
এছাড়া বিকল্প কাঁচামাল হিসেবে ‘সুগার বিট’ বেছে নেয়া সম্ভব। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে এটি নতুন শস্য হলেও এরই মধ্যে শ্যামপুর চিনিকল এলাকায় এ শস্যটি পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে।
আখের তুলনায় কম সময়ে চাষ উপযোগী ‘সুগার বিট’ থেকে চিনি আহরণের জন্য অল্প কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হলে শ্যামপুর সুগার মিলস কাঁচামাল সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে। এছাড়া বিএমআরআইয়ের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর- রশিদ চৌধুরী শেয়ারবার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটি রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান কি ভাবে বছরের পর বছর লোকসানে থাকে। বিএসইসি তাদের আইপিও ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আইপওতে আসার জন্য আবেদন করা কোম্পানিটি ভাল কি মন্দ সে বিষয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। একটা দুর্বল কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে বাজারে আসার পর দেখা যায় তার লাভ কমে যাচ্ছে। শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে।
কোনো ডিভিডেন্ট দিতে পারে না। তখন কোম্পানিটি চলে যায় জেড ক্যাটাগরিতে। তখন হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ নিয়ে পড়েন বিপাকে। এজন্য বিএসইসিকে দায়ী করেন তিনি। এসব গেম বন্ধ করতে দ্রুত ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট এবং বাই ব্যাক আইন পাশ করার দাবি জানান। তাহলে কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা বাড়বে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুদ দিতে পারে তাহলে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ট দিতে পারবে।
এছাড়াও কোম্পানিগুলো বাজারে আসার আগে মুনাফা বেশি দেখিয়ে আইপিওতে আসে এবং মূলধন তুলে নেয়। বাজারে তালিকাভূক্তির পর দেখা যায় কোম্পানি লোকসানে আছে বা লোকসান হয়েছে। এই ইস্যুতে বিনিয়োগকারিদের জন্য নো ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে। আর এটি বিনিয়োগকারিদের ঠকানোর সহজ পথ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান শেয়ারবার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি লভ্যাংশ দিল কি দিল না তা বিএসইসি দেখার বিষয় নয়। কোম্পানি লাভ করল কি করল না তা কোম্পানির ব্যাপার।