মাকসুদ কমিশনে আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের, ১৩ মাসে সূচক উধাও ৬৯৩ পয়েন্ট
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও ব্যতিক্রম শুধু পুঁজিবাজার। গত ১৩ মাসে পুঁজিবাজারের বৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো প্রতিদিনই কমছে মূল্যসূচক ও বাজার মূলধন। ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার ইঙ্গিত মিললেও পুঁজিবাজার চলছে সেই পুরানো উল্টো পথে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ মাস পুঁজিবাজারের কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বারবার আস্থার সংকট, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোন অবদান রাখতে পারছে না পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীরা মনে করে বিএসইসির অদক্ষ্য ও অযোগ্য কমিশনের কারণে বেহাল দশা দেশের পুঁজিবাজারের।
এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল না করে বাজার সংস্কারের নামে অস্থিতিশীল করছেন। ফলে ক্রমান্বয়ে পুঁজিবাজার ডুবতে বসেছে। স্পর্শকাতর এই খাতটির সঙ্গে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীদের সরাসরি বিনিয়োগ জড়িত, প্রতিদিনের লেনেদেনের প্রতিফলন ঘটে সূচক উঠা-নামার মাধ্যমে, ফলে বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়াটিও সূচকের সমান্তরাল রেখায় প্রতিফলিত হয়। সূচক ও লেনদেন তলানিতে নামছে, যেন দেখার কেউ নেই।
ফলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কমিশনের ওপর আস্থা পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। গত বছরের ১৮ আগস্ট চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচক কমেছে ৬৯৩ পয়েন্ট। মুলত রাশেদ মাকসুদ কমিশন যখন দায়িত্ব নেয় তখন ডিএসই সূচক ছিলো ৫৭৭৮.৬৩ পয়েন্ট। সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে সোমবার ডিএসইর সূচক এসে দাঁড়িয়েছে ৫০৮৬.৮৫ পয়েন্ট।
আর দৈনিক লেনদেনের ধীর গতিতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া কমিশন সংক্রান্ত বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে তৈরি করেছে আস্থার সংকট। অন্যদিকে কোন বিনিয়োগকারী বেশী পরিমাণ শেয়ার কিনলেই বিএসইসি থেকে ফোন দিয়ে কারণ জানতে চাওয়া হয়।
এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ মাস পুঁজিবাজারে কোনো নতুন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন হয়নি। অনেক আশা নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন কমিশন নিয়োগ করলেও সেই আশায় গুড়েবালি। আস্থার বদলে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থাই কুড়িয়েছে এ সময়টা ধরে। বাজারের লেনদেন তলানিতে নামা, বড় অঙ্কের সূচকের পতন ঘটা থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশার সময় কাটছে।
অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ শীর্ষ ব্যক্তিদের খামখেয়ালীপনা, বাজার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, নানা হঠকারী সিদ্বান্ত, ব্যক্তিগত অভিপ্রয়াস, পুঁজিবাজারের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে অবমূল্যায়ন, কমিশনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানাবিধ কারণে দেশের পুঁজিবাজার বর্তমানে ধ্বংসের দারপ্রান্তে।
বিশেষ করে বাজারকে স্থিতিশীল করতে সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে আগের সময়ের ছোট ছোট ভুল ত্রুটিকে সামনে এনে বড় অঙ্কের জরিমানা ও অন্যান্য শাস্তির মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় ছোট একটি ভুলের কারণে যেখানে ১০ লাখ টাকা জরিমানা শ্রেয়, সেখানে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে বিপাকে ফেলতে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হচ্ছে।
এই জরিমানার টাকা আসলে কোনভাবেই উসুল করা সম্ভব নয়; কারণ ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হয়তো ওই জরিমানার অর্থ প্রদানের সক্ষমতাই নেই। অথবা তিনি মামলা করে সিদ্ধান্ত আটকে দিবেন। অপরদিকে, এ ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্তে বাজার ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে আস্থাহীনতায় ইতোমধ্যে বাজার ছেড়েছেন হাজারো বিনিয়োগকারী। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৪ মাস পুঁজিবাজারে কোনো নতুন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন হয়নি। এমনকি ১৭টি আইপিও বাতিল করছে বর্তমান কমিশন।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্যমতে, ঠিক পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ, গত মে মাসে পুঁজিবাজারে মোট বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫১১টি, যা সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর বুধবার ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫টিতে নেমে আসে। অর্থাৎ গত পাঁচ মাসে পুঁজিবাজারে ৪৭ হাজার ৪৭৬টি হিসাব বন্ধ হয়েছে। শুধু হিসাবধারীই নয়; বাজার মূলধনও প্রতিদিন কমছে।
চলতি মাসের ১২ থেকে ১৬ অক্টোবরেই বাজার মূলধন কমেছে ৩১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। গত এক বছরে বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত পুঁজি কমেছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। আগে একসময়ে বাজার মূলধন কমলেই দোষারোপ করা হতো সালমান এফ রহমানসহ একাধিক ব্যক্তির নামে। আর সালমান এফ রহমান বর্তমানে জেলে আছেন। তাহলে বর্তমান বাজার মূলধনের হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় যাচ্ছে?
এর মধ্যে নতুন করে কোম্পানি পুঁজিবাজারে না আসা যোগ করেছে হতাশার নতুন মাত্রা। লে দেশের পুঁজিবাজার যেন ধীরে ধীরে এর পথ হারাচ্ছে। এক সময় এই বাজার ছিল স্বপ্ন বুননের ক্ষেত্র হাজারো সাধারণ বিনিয়োগকারী আশায় বুক বাঁধতেন, শেয়ার কিনে জীবনের উন্নতির গল্প লিখতেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের টানা মন্দাভাব, আস্থাহীনতা আর অস্থিরতায় সেই স্বপ্নের জায়গায় এখন ভর করছে হতাশা।
এর ফলে গত ৯ মাসেই ৬২ হাজার বিনিয়োগকারী নিস্কিয় হয়ে পড়েছেন। কেউ পুরোপুরি বাজার ছেড়েছেন, আবার অনেকেই শেয়ারহীন হয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচলে সময় পার করছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্যে এ চিত্রই উঠে এসেছে।
ফলে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হাসিনার পতনের পর সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে। পুঁজিবাজারে আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে ১৭টি বিষয়ে সংস্কার সুপারিশ করা হয়। এই টাস্কফোর্সের পেছনেও সরকারের বড় অঙ্কের অর্থ ঢালতে হয়েছে। অথচ টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়নের নাম নেই। এছাড়া চলতি বছরের মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি কয়েকটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন।
সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে (এমএনসি) থাকা সরকারি শেয়ার অফলোড ও দেশীয় বড় বড় কোম্পানিকে তালিকাভুক্তি করা এবং বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংকঋণ নেওয়ার বদলে পুঁজিবাজারে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
এই নির্দেশনার পর ইতোমধ্যে ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু কোনকিছু বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। একই সঙ্গে ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে (এসওই) বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে। আর তাই বাজারে উল্টো চিত্র বিরাজমান। প্রতিদিন পুঁজি হারিয়ে হতাশ বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রস্তাবিত মিউচ্যুয়াল ফান্ড নীতিমালা ২০২৫ (ড্রাফট) প্রণয়ন করা হয়েছে। যা আগামী দিনে পুঁজিবাজারকে আরো খাদের কিনারে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীতিমালা পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়নের পরিবর্তে দেশের পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে পৌঁছাবে।
মুলত পুঁজিবাজারে অস্থিরতার জন্য বিএসইসি’র প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের দায়ী করছেন বিনিয়োগকারীরা। তাঁদের দাবি, কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী ফোর্সড সেলের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এতে তাদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে হতাশাও। বাজারের টানা দরপতনের প্রতিবাদে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অপসারণের দাবি করেছেন শেয়ার বাজারের বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি এ নিয়ে বিক্ষোভ করেন বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা।
সূত্র মতে, গত বছরের ১৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানা হুটহাট সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বর্তমান রাশেদ মাকসুদ কমিশন। অথচ সবাই মনে করেছিল নতুন, সংস্কারমুখী নেতৃত্ব বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করবে, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন আনবে এবং ডুবন্ত পুঁজিবাজারকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু ঘটছে উল্টো।
এমনকি সম্প্রতি প্রস্তাবিত মিউচ্যুয়াল ফান্ড নীতিমালা ২০২৫ (ড্রাফট) প্রণয়ন করা হয়েছে। সবাই আশা করেছিল এই নীতিমালায় ভালো কিছু থাকবে। কিন্তু যা রাখা হয়েছে তা দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারকে টেকসই উন্নয়নের পরিবর্তে ধ্বংস করবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

