ফিনিক্স ফাইন্যান্সের পাতানো ‘এজিএম’ পরিচালনার অভিযোগ
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে অনিয়মের শেষ নেই। এসব অনিয়মের কারণে বাজার তার সঠিক অবস্থানে ফিরতে পারছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিনিয়োগকারীদের সঠিক তথ্য দেওয়া হয় না। প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগকারীদের বছরের পর বছর বঞ্চিত করা হয়। কোম্পানির বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া এবং দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে এজিএম সম্পন্ন করে কোম্পানির এজেন্ডা পাস করানোর হয়। এতে বিনিয়োগকারীদের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করা হচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে।
মুলত ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে এজিএমে (বার্ষিক সাধারণ সভা) অনিয়ম, বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন করার সুযোগ না দেওয়া এবং আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর অসঙ্গতি আড়াল করার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন এক বিনিয়োগকারী।
তার দাবি প্রতিষ্ঠানটি তথাকথিত সাজানো এজিএম আয়োজন করে ভুলে ভরা বার্ষিক প্রতিবেদন পাশ করিয়েছে। তবে এ অভিযোগের বাইরেও কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষনে দেখা যায় কোম্পানিটি নিয়মিত ক্ষতির মুখ থেকে উত্তরণে আসতে পারছে না বরং আরও ধ্বসের দিকেই যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীর অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ২১ আগস্ট ২০২৫ তারিখে আইডিইবি ভবনের মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ফিনিক্স ফাইনান্সের এজিএমে বিনিয়োগকারীগণ উপস্থিত ছিলেন। একজন বিনিয়োগকারী বার্ষিক প্রতিবেদনের অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করার চেষ্টা করলে কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা, কন্টাক্ট করা পক্ষের শেয়ারহোল্ডার এবং ভাড়া করা কিছু নন শেয়ারহোল্ডার তাকে বাধা দেয়। এতে তিনি কোনো প্রশ্ন তুলতে বা আলোচনায় অংশ নিতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি লিখিতভাবে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর প্রশ্নপত্র জমা দিলেও দীর্ঘ সময়েও কোনো উত্তর পাননি।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের কোম্পানি ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি চলছে। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের অর্ধেকের বেশিই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে সংস্থান ও মূলধন ঘাটতি। সম্পদের গুণগত মান দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় পুঞ্জীভূত লোকসান দিন দিন বাড়ছে। ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রতি ব্যপক আস্থার সংকট থাকায় নতুন করে আমানতও পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। তীব্র তারল্য সংকটে পড়তে হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে।
অবস্থা এমন পর্যায়ে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি দিন দিন প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বেড়েই চলছে। এজন্য গত কয়েকবছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিচ্ছে না কোম্পানিটির। সার্বিক আর্থিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের এমন দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।
ব্যাংক বহির্ভূত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির এমন দুর্দশার জন্য অযোগ্য নেতৃত্বকে দায়ী করছে খাতসংশ্লিষ্টরা। অযোগ্য নেতৃত্বের ফলে প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক বছর ধরে লোকসানে রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) দেয়া তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের পর ফিনিক্স ফাইন্যান্স শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি।
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের দুরবস্থার জন্য সাাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম ইন্তেখাব আলমের অযোগ্য নেতৃত্বই দায়ী। কারণ শীর্ষ পদটিতে ২০০৮ সাল থেকে টানা ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডিকে সম্প্রতি বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এস এ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, আমান সিমেন্ট মিলস ইউনিট-২, মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ম্যাক স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং গ্রাহক নাজমা পারভিন, ফারহান মোশাররফের ঋণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন থাকার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি বর্তমানে ১৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ক্রমাগত লোকসানের অন্যতম কারণ হচ্ছে নামে-বেনামে ঋণ দেয়া। কোম্পানিটি বিভিন্ন সময় ঋণ দিলেও সেটি পরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে একসময় নতুন মূলধন জোগান ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আর্থিক খাতের যত অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়েছে, তার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে জামানতবিহীন কিংবা ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার তথ্য মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে জামানত নিলেও তা অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুয়া গ্যারান্টির বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। আর এ তালিকার প্রথম দিকেই আছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স।
অভিযোগে বলা হয়, কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০২৪ অর্থবছরের প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, অথচ প্রতিবেদনে লস দেখানো হয়েছে ৮০৮ কোটি ২৩ লাখ টাকারও বেশি। এতে প্রভিশন হিসেবে দেখানো অর্থের হিসাবও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে ভবিষ্যৎ ক্ষতির জন্য ৫০৪ কোটি টাকার বেশি সংস্থান করা হয় এবং ২০২৪ সালে প্রায় ৫৭১ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয় যা প্রকৃত ক্ষতির চেয়ে বহুগুণ বেশি। এসব সংস্থান বাদ দিলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতে থাকার কথা থাকলেও প্রতিবেদনে তার কোনো উল্লেখ নেই।
অভিযোগে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন ১৬৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যার প্রায় ৪৯ শতাংশ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭১৮ কোটি টাকার বেশি, অথচ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকারও বেশি। বিনিয়োগকারীর প্রশ্ন এই ঘাটতি পূরণের অর্থ কোথা থেকে এল এবং ১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকার প্রভিশন করার মতো তহবিলের উৎস কী?
বিনিয়োগকারী তার লিখিত অভিযোগে বলেছেন, ফিনিক্স ফাইনান্সসহ একাধিক কোম্পানি তথাকথিত ‘এজিএম পার্টি’ মাধ্যমে এজিএম পরিচালনা করেছে, যেখানে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বা প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। এসব সভায় কৃত্রিম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ভুলে ভরা প্রতিবেদন কোনো আলোচনা ছাড়াই পাশ করা হচ্ছে। ফলে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা আড়াল হয়ে যাচ্ছে এবং জবাবদিহিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা বিএসইসির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, ভাড়া করা লোক দিয়ে এজিএম আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং ফিনিক্স ফাইনান্সের অনিয়ম তদন্ত করে বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নের উত্তর প্রদানের ব্যবস্থা করা হোক। তার অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সাধারণ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না করে কেবল কিছু সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে, যাদের মধ্যেই অনেকেই এজিএম অনিয়মে জড়িত।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের সাজানো এজিএম এবং আর্থিক প্রতিবেদনে অসত্য তথ্য উপস্থাপন বাজারে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও নিরুৎসাহিত হবে, যা সার্বিকভাবে পুঁজিবাজারের জন্য নেতিবাচক বার্তা বহন করছে।
ফিনিক্স ফাইনান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোম্পানিটির বিনিয়োগ, টোটাল অ্যাসেট, ফিক্সড অ্যাসেট ও এফডিআর সব-ই কমেছে গত তিন বছরে। রিপোর্টে দেখা যায় ২০২৩ সালে কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল ১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা যা ২০২৪ সালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
২০২৩ সালে টোটাল অ্যাসেট ছিল ২ হাজার ৯১৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা কিন্তু ২০২৪ সালে তা কমে দাড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ফিক্সড অ্যাসেটের ক্ষেত্রেও নিয়মিত ধ্বস নেমেছে কোম্পানিটির। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির ফিক্সড অ্যাসেট ছিল ৬৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬২ কোটি ২২ লাখ টাকায়।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যেখানে মোট দায় ৪ হাজার ১৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির ওপর দায় সম্পদের তুলনায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেশি। এটি প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো এর ক্লাসিফায়েড বা শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ।
প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ৮৮.৬৬ শতাংশ এখন অনাদায়ী অবস্থায় রয়েছে যা দেশের যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনা করলে দেখা যায় বে লিজিংয়ের ৮০.৮৪ শতাংশ, ইসলামিক ফাইন্যান্সের ৫৮.৫৭ শতাংশ এবং প্রাইম ফাইন্যান্সের ৬০.২৯ শতাংশ ঋণ ক্লাসিফায়েড যেখানে ফিনিক্সের অবস্থান সবচেয়ে বিপজ্জনক।
ফিনিক্স ফাইন্যান্স গত অর্থবছরে কর-পরবর্তী ক্ষতি দেখিয়েছে ৮০৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। একই সময়ে এর ইপিএস দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৪৮.৭৩ এবং এনএভি ঋণাত্মক ৮২.০১। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি এখন নেতিবাচক ১ হাজার ৩৬০ কোটি ৩০ লাখ টাকা যা ইঙ্গিত করে যে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত মূলধন হারিয়ে ফেলেছে।

