শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৬ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৪ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা ৯৪ লাখ টাকা। তবে ১১ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৪ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে (এপ্রিল-জুন) দেশের ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে দুই হাজার ২২৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে ঋণমানের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি ১১ ব্যাংক।

এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি, বেসরকারি ৬টি ও ১টি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক আর বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল টাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এছাড়া বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।

জুন মাস শেষে এই ১১ ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এ ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৮৭৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যদিও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ ৫ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন (২০২১) প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক শূন্য ১৮ শতাংশ।

গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ৪৭১ কোটি টাকার বেশি। আলোচিত সময়ে যে ১১ ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে তার মধ্যে সরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি ১১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি জনতা ব্যাংকের।

জুন শেষে জনতা ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এরপরই বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ৫২৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ৯৪৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। বেসরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৩৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের।

জুন মাস শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দুই হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৮২ কোটি ৪০ লাখ, ঢাকা ব্যাংক ২০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৫৯ কোটি ৬২ টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৫ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি ১০৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২১ কোটি ৬ লাখ টাকা।

কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫৮২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশনিং। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়।

এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম দশমিক ২৫ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ, ৫ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি। এছাড়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে প্রভিশনিং করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে এতে ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডাদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ায় তা আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ছাড়ের কারণে গ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে খেলাপির পাশাপাশি প্রভিশন ঘাটতিও বেড়েছে। যারা প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

তিনি বলেন, ঋণের ঝুঁকি কমাতে হলে আদায় বাড়াতে হবে। যাচাই-বাছাই করে সঠিক নিয়মে ঋণ দিতে হবে। ঋণ আদায়ের জোড় দিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। এখন ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য আছে, এ অর্থ সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। বড় ঋণে নিরুৎসাহিত করে ছোট ছোট ঋণে বেশি জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক এ গভর্নর। এছাড়া নির্দিষ্ট কোনো ব্যাংকে অপ্রীতিকর ঘটনা বেশি বেশি ঘটলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা শক্তিশালী হওয়া দরকার বলেও মনে করেন তিনি।