শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) জারি করা বিধান কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড (সিজিসি) এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগেুলেশন অনুযায়ী পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রত্যেক কোম্পানির সচল ‘অফিসিয়াল ওয়েবসাইট’ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি এ বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করলেও ৯টি কোম্পানি তা আমলেই নিচ্ছে না। প্রায় তিন মাস ধরে এসব কোম্পানির ওয়েবসাইট পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

এছাড়া তালিকাভুক্ত আরো ২টি কোম্পানি রয়েছে, যাদের ওয়েবসাইট নামেমাত্র সচল রয়েছে। তবে তাতে প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য নেই। ফলে ওই কোম্পানিগুলোর সকল অপরিহার্য তথ্য থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা, যা কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড এবং লিস্টিং রেগুলেশনের পুরোপুরি লঙ্ঘন।

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ডিবেঞ্চার, কর্পোরেট ও ট্রেজারি বন্ড বাদে সর্বমোট ৩২০টি কোম্পানির (পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বাদে) ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ এবং অনুসন্ধানে এসব তথ্য তথ্য পাওয়া গেছে।

ওয়েবসাইট বন্ধ থাকা ৯টি কোম্পানি হলো- বঙ্গজ লিমিটেড, জুট স্পিনার্স লিমিটেড, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ লিমিটেড, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল লিমিটেড, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড, মিথুন নিটিং এন্ড ডায়িং লিমিটেড, তাল্লু স্পিনিং মিলস লিমিটেড, তুং-হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড এবং জাহিন স্পিনিং লিমিটেড। এসব কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৭টি অর্থাৎ জুট স্পিনার্স লিমিটেড, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ লিমিটেড,

সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল লিমিটেড, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড, মিথুন নিটিং এন্ড ডায়িং লিমিটেড, তাল্লু স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও তুং-হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড ‘জেড’ ক্যাটাগরির। বাকি ২টির মধ্যে বঙ্গজ লিমিটেড ‘এ’ এবং জাহিন স্পিনিং লিমিটেড ‘বি’ ক্যাটাগরির কোম্পানি।

আর নামেমাত্র সচল কোম্পানিগুলো হলো- পদ্মা ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এবং দ্য ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। গতকাল পর্যন্ত এসব কোম্পানির ওয়েবসাইট বন্ধ পাওয়া গেছে।

এছাড়া ওই ১১টি কোম্পানির মতোই আরও ৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রয়েছে, যাদের নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইট নেই। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট্ েকোম্পানিগুলোর অস্তিত্বের তথ্য রয়েছে। তবে সেখানে বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য নেই বললেই চলে।

কোম্পানি ৩টি হলো- শিল্প মন্ত্রণালয়ের চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড, জিল বাংলা সুগার মিলস লিমিটেড ও রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেড। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত এমন আরো ১৪টি কোম্পানি রয়েছে, যাদের নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইট নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখলেই ওই কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব বোঝা যায়। তবে সেখানে বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য (বিভিন্ন প্রান্তিক প্রতিবেদন, আর্থিক প্রতিবেদন, বার্ষিক প্রতিবেদন) রয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট না থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলেও, জোরালো পদক্ষেপের অভাবে তা কার্যকর হচ্ছে না। বিনিয়োগে ঝুঁকি এড়াতে কোম্পানি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যথাসময়ে জানতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এর দায় ডিএসই, সিএসই ও বিএসইসি কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রায় তিন মাস ধরে ওই ৯টি কোম্পানির ওয়েবসাইট বন্ধ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট সচল হয়েছে কি-না তা দেখার চেষ্টা করা হয়। তবে যতবারই চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই তা বন্ধ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বঙ্গজ লিমিটেড, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল লিমিটেড, তাল্লু স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও জাহিন স্পিনিং লিমিটেডের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলেই “ঞযরং ংরঃব পধহ’ঃ নব ৎবধপযবফ” দেখাচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে তা দেখা যাচ্ছে না। জুট স্পিনার্স লিমিটেড ও তুং-হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেডের ওয়েবসাটের ঠিকানা ভুল দেখাচ্ছে।

এছাড়া জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেডের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলেই “ডবনংরঃব ঊীঢ়রৎবফ” দেখাচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের ওয়েবসাটের ঠিকানা থাকলেও তা সচল নয়। সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ লিমিটেডের ওয়েবসাইটটি হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়ায় পর থেকেই তা আর দেখা যাচ্ছে না।

আর তালিকাভুক্ত পদ্মা ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এবং দ্য ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের ওয়েবসাইট নামেমাত্র সচল রয়েছে। তবে তাতে প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য নেই। ফলে কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট না থাকায় প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা, যা কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড এবং লিস্টিং রেগুলেশনের পুরোপুরি লঙ্ঘন।

এছাড়া শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড, জিল বাংলা সুগার মিলস লিমিটেড ও রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেডের দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইট নেই। কোম্পানি ৩টি শিল্প মন্ত্রণালয়ের চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটের লিংকটি ডিএসই ও সিএসই’র ওয়েবসাইটে নিজেদের বলে দিয়ে রেখেছে। তবে সেখানে প্রান্তিক প্রতিবেদন, আর্থিক প্রতিবেদন, বার্ষিক প্রতিবেদন নেই। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। ফলে ওই কোম্পানিগুলো কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ও লিস্টিং রেগুলেশন মানছে না।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট থাকার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বিএসইসি’র কর্পোরেট গভর্নেন্স কোডের শর্ত (সেকশন) ৮ এ উল্লেখ রয়েছে- প্রত্যেক কোম্পানির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থাকবে। ওই সকল কোম্পানির ওয়েবসাইটের লিংক স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। একইসঙ্গে তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদনের পর থেকেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওয়েবসাইট সচল থাকবে। এছাড়া কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকবে।

এদিকে একই বাধ্যবাধকতার বিষয়ে ডিএসই ও সিএসই’র লিস্টিং রেগুলেশনের ৪৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে- প্রত্যেক ইস্যুয়ারের (কোম্পানি) অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থাকবে, যার লিংক স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে সংযুক্ত থাকবে।

এছাড়া তালিকাভুক্তির পর থেকে ওই কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে যেসব তথ্য থাকতে হবে সেগুলো হলো- ব্যবসাসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড; ছবি সম্বলিত পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ-ব্যবস্থাপনা কমিটি; বার্ষিক ও প্রান্তিক আর্থিক বিবরণী; সর্বশেষ পরিচালকের প্রতিবেদন; সকল মূল্য সংবেদনশীল তথ্য; পরিচালক/উদ্যোক্তা, ইনস্টিটিউশন ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারধারণের বিস্তারিত তথ্য; পরিচালক/উদ্যোক্তা, ইনস্টিটিউশন এবং সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার লেনদেন ও তা কেনা/বেচার ঘোষণার তথ্য, কর্পোরেট গভর্নেন্স পরিপালনের তথ্য এবং যোগাযোগের ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য।

ওয়েবসাইট বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে জাহিন স্পিনিং লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মহিন উদ্দিন বলেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণে আমাদের ওয়েবসাইটে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ বিষয়টি ডিএসইও আমাদেরকে অবহিত করেছে। ইতোমধ্যে আমারা ওই কারিগরি ত্রুটির সমাধান করে ডিএসইকে জানিয়েছি। তবে আপনাদের অভিযোগটি আমরা আবার খতিয়ে দেখব।’

একই প্রসঙ্গে সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ লিমিটেডের কোম্পানি সচিব সৈয়দ মো. জাকারিয়া বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের ওয়েবসাইটটি হ্যাকিং এর শিকার হয়েছে। আমারা তা উদ্ধার করেছি। ওয়েবসাইটটি দ্রুত চালু করার বিষয়ে জোর চেষ্টা চলছে। আশা করছি এ মাসের (ফেব্রুয়ারি) মধ্যেই ওয়েবসাইটটি চালু হবে।’
এদিকে নিজ কোম্পানির ওয়েবসাইটটি বন্ধের কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি আজাদ আহসান বাচ্চু বলেন, “বেশ কয়েকটি কোম্পানির ওয়েবসাইট না থাকার বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণেও এসেছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য এ বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। ওয়েবসাইট না থাকার কারণে কোনো বিনিয়োগকারীই প্রয়োজনীয় তথ্য পাচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ ভাবছেন কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে গেল কি-না! কারণ ওয়েবসাইট বন্ধ থাকা অধিকাংশ কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরির। এ বিষয়টি ডিএসই, সিএসই ও বিএসইসি’র আরো কঠোর ভাবে দেখা উচিত।”

কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট বন্ধ থাকার প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ বলেন, ‘আপনাদের পর্যবেক্ষণে যেসব অসঙ্গতি উঠে এসেছে তা আমাদেরকে লিখিতভাবে দেন। সেসব অসঙ্গতি যাচাই বাছাই সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

একই বিষয়ে ডিএসই’র পরিচালক ও শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট বন্ধ থাকা মোটেও উচিত নয়। এতে বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এদিকে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি ও শহীদুল্লাহ সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানিরই ওয়েবসাইট বন্ধ থাকা কাম্য নয়। ওয়েবসাইট না থাকলে বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে বঞ্চিত হবেন। এ বিষয়ে ডিএসই’র দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’

বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য সিজিসিসহ অন্যান্য আইন ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনো কোম্পানি যদি ওই সকল আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে বিএসইসি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’