শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: রেকর্ড তারিখের পরও দাম সমন্বয় না হওয়ায় লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ারে আবারও বিশেষ সুবিধা পেল প্লেসমেন্ট শেয়ারের ক্রেতারা। এমনিতেই কোম্পানিটি বিশেষ আইনি ছাড় নিয়ে সাধারণ শেয়ারধারীদের বাইরে মাত্র ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের সংখ্যা বাড়লেও শেয়ারের দামের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধান কার্যকর করা হয়নি। যার ফলে বাড়তি সুফল পাবেন প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত রোববার লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের রেকর্ড তারিখপরবর্তী লেনদেন শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী, যখন কোনো কোম্পানি নতুন করে শেয়ার ইস্যু করে, তখন রেকর্ড তারিখের পরদিন ইস্যু করা শেয়ারের আনুপাতিক হারে ওই কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য সমন্বয় করা হয়। কিন্তু লিগেসি ফুটওয়্যারের ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনক্রমে ডিএসই লিগেসির শেয়ারের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে।

এর আগে কোম্পানিটি ব্যাংকঋণ ও নতুন করে শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। এসব সুবিধা পাওয়ায় কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে বাজারে বড় ধরনের কারসাজির ঘটনাও ঘটেছে। নতুন করে গত রোববার দাম সমন্বয়ে বিশেষ সুবিধা পাওয়ায় তাতে প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীদের পাশাপাশি কারসাজিকারকদেরই পোয়াবারো হয়েছে। কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে, সেটি জেনে নেওয়া যাক এবার।

সম্প্রতি কোম্পানিটি নতুন করে ৩ কোটি শেয়ার ইস্যু করে ৩০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। কোম্পানিটির এ উদ্যোগও ছিল প্রচলিত ধারার চেয়ে ব্যতিক্রমী। তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে নতুন করে মূলধন সংগ্রহের প্রচলিত উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে অধিকারমূলক বা রাইট শেয়ার ইস্যু, পুনঃপ্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা রিপিট আইপিও।

কোম্পানিটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় রাইট, রিপিট আইপিওর মাধ্যমে নতুন শেয়ার ইস্যু করা সম্ভব ছিল না। তাই কোম্পানিটি প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন করে মূলধন সংগ্রহের পথ বেছে নেয়। তাতে সম্মতিও দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কোম্পানিটি মোট ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন ৩ কোটি শেয়ার বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়, যার বিক্রয়মূল্য ধরা হয় ১০ টাকা।

অথচ কোম্পানিটির শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৯০ টাকা। যখন ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তখন শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১০০ টাকারও বেশি। প্লেসমেন্টে শেয়ারের জন্য বিবেচিত ব্যক্তিদের মধ্যে কোম্পানির তিনজন উদ্যোক্তা-পরিচালকও রয়েছেন। বাকি ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কোম্পানির বিশেষ পছন্দের। কোম্পানিটির এমন উদ্যোগের ফলে বঞ্চিত হয়েছেন বিদ্যমান সাধারণ শেয়ারধারীরা।

নিয়ম অনুযায়ী, লিগেসির নতুন শেয়ার ইস্যুর জন্য রেকর্ড তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৮১ টাকা ২০ পয়সা। সেই দামের ওপর ভিত্তি করে রেকর্ডপরবর্তী লেনদেনের দিনে, অর্থাৎ গতকাল রোববার কোম্পানিটির শেয়ারের দাম সমন্বয় হয়ে হওয়ার কথা ছিল ৩১ টাকা ৬০ পয়সা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্তে বিএসইসির পরামর্শে সেই দাম আর সমন্বয় করা হয়নি। এর ফলে লিগেসির এ ঘটনা শেয়ারবাজারে ‘অভিনব ঘটনা’ হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়ে থাকল।

জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘দাম সমন্বয়ের বিষয়ে আমরা কিছু জানা নেই। এটি ডিএসইর বিষয়। শেয়ারের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিএসইসির কোনো নির্দেশনা নেই।’

লাভবান হলেন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তরা: লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয় সাধারণ শেয়ারধারীদের মধ্যে শেয়ার ইস্যু না করায়। যদি দাম সমন্বয় করা হতো, তাহলে কোনো শেয়ার না পাওয়ার পরও বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমে গেলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি থেকে বাঁচাতে দাম সমন্বয় থেকে সরে আসে ডিএসই। তাতে সম্মতি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু এতে লাভবান হয়েছেন প্লেসমেন্টে শেয়ার পাওয়া হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং কারসাজিকারকেরা। প্লেসমেন্টে ১০ টাকা করে শেয়ার ইস্যু করায় তাতে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে শেয়ার পাচ্ছে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বাজারে দাম সমন্বয় হলে তাতে তাদের মুনাফার পরিমাণ কিছুটাও কমত। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, যে পদ্ধতিতে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের নতুন শেয়ার ইস্যু করছে, তা বাজারে বিরল। এর বিপরীতে শেয়ারের দাম সমন্বয় করা হলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ত। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় দাম সমন্বয় করা হয়নি; যদিও এ ধরনের ঘটনা শেয়ারবাজারে আগে ঘটেনি।

যারা পেল প্লেসমেন্ট শেয়ার: প্রাইভেট প্লেসমেন্টে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ার যারা পেয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক। এ ছাড়া কোম্পানিটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হলো কাজী রাফি আহমেদ, কাজী আজিজ আহমেদ, কাজী নাফিস আহমেদ ও এম কে ফুটওয়্যার। তাদের মধ্যে কাজী রাফি আহমেদ কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

তাদের বাইরে অন্য যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শেয়ার পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অপর কোম্পানি সি-পার্ল বিচ রিসোর্ট, হোটেলটির মালিক আমিনুল হক, রিভারস্টোন, এনএসআরএ ইকুইটিস, এনএএসসিএফএস ইকুইটিস, নীরদ বড়ুয়া, এসএএম ইকুইটিস, হায়াত ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হাবিব এন্টারপ্রাইজ, শিরিনতা সাবরিন চৌধুরী,

লামিম এন্টারপ্রাইজ, আহমেদ ফারাবী চৌধুরী ও টিএস ইকুইটি অ্যান্ড ভেঞ্চারস লিমিটেড। এর মধ্যে আহমেদ ফারাবী চৌধুরী ও টিএস ইকুইটি অ্যান্ড ভেঞ্চারসের ঠিকানা একই। তাই বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, উল্লিখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

দাম বাড়াতে কারসাজি: মূলধন বাড়াতে কোম্পানিটিকে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। এ জন্য অনুমোদন চেয়ে মার্চে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বিএসইসিতে আবেদন করা হয়। প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যুর আবেদনের পর থেকে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে। ২০ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৪২ টাকা। সেই দাম ৬ আগস্ট বেড়ে হয় ১৩৬ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানিটি রূপালী ব্যাংকের কাছে ঋণের সুদ মওকুফেরও আবেদন করে।
লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের দীর্ঘদিন ধরে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক ছিল। খেলাপি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এককালীন পরিশোধের শর্তে সুদ মওকুফের বিশেষ সুবিধা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। লিগেসি ফুটওয়্যারের আবেদনের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংক এককালীন অর্থ পরিশোধের শর্তে ২০ কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করে। জানা গেছে, লিগেসি ফুটওয়্যার প্লেসমেন্টে তাদের পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে মূলধন সংগ্রহ করছে, তা থেকে ঋণের বাকি অর্থ পরিশোধ করবে। বাকি অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

সুদ মওকুফের আনুষ্ঠানিক তথ্য ডিএসইর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানোর আগে এ-সংক্রান্ত তথ্য বাজারে ঘুরছিল, যা কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কারসাজিকারকেরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।

শেয়ারবাজারে এ ধরনের খবর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব তথ্য আগাম জেনে কারসাজিকারকেরা সাধারণত শেয়ারের দাম বাড়ানোর কাজে লাগান। অনেক সময় কোম্পানির উদ্যোক্তারাও আড়ালে থেকে শেয়ারের দাম বাড়ানোর স্বার্থে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকেন।