শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি রানার অটোমোবাইলস লিমিটেডের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ লুটে খাওয়ার অভিযোগ উঠছে। কোম্পানিটির সম্পদ শীর্ষ কর্মকর্তারা লুটোপুটে খেলেও বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে কিছু জুটছে না। বরং দিনের পর দিন কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা অবনতির দিকে। উচ্চ প্রিমিয়াম নেয়া রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড এখন বড় লোকসানের মুখে।

অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে পুঁজিবাজারে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রতিটি শেয়ার ৭৫ টাকা করে ইস্যু করে রানার অটোমোবাইল। এমন উচ্চ ইস্যু মূল্যের কোম্পানিটির পর্ষদ ২০১৯ সাল থেকে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসলেও এবার লোকসানের মুখে।

এবার কোম্পানিটি ডিভিডেন্ড দিতে পারবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ কোম্পানিটির তিন প্রান্তিক মিলে বড় লোকসানে। এই কোম্পানিটির কাট-অফ প্রাইস যে অতিমূল্যায়িত করা হয়েছিল, সেটা ওইসময়ই অভিযোগ উঠেছিল। যা করতে ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা রাখে বলে অভিযোগ ছিল। এখন কোম্পানির শেয়ার দর কাট-অফ প্রাইসের নিচে চলে এসেছে।

বুক বিল্ডিংয়ে আসা কোম্পানিগুলো কাট-অফ প্রাইস অতিমূল্যায়িত করার জন্য ইস্যু ম্যানেজারের সহযোগিতায় কারসাজি করেছে, সে অভিযোগ অনেক আছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে আসার আগে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত করে মুনাফা দেখানোর অভিযোগ আরও পুরোনো। এরমাধ্যমে অনেক কোম্পানি উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করে টাকা তুলে নিয়েছে। যাতে করে তালিকাভুক্তির পরে শেয়ারহোল্ডারদেরকে দিতে পারছে না সঠিক লভ্যাংশ। এছাড়া কমে এসেছে মুনাফার পরিমাণ।

এদিকে কোম্পানিটির মুনাফা থেকে লোকসানে গেলেও কোম্পানিটির শীর্ষ দুই কর্মকর্তার ভাগ্যের চাকা ঘুরছে। ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিজ নামে ও নামসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করে অজ্ঞাত ও অবৈধ উৎস হতে অর্থ জমা করেছেন কোম্পানিটির সেক্রেটারী মিজানুর রহমান। জমা করা অর্থ দিয়ে ব্যক্তিগত ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নামে বিভিন্ন সম্পদে রূপান্তরের বিষয়টি দুর্নীতির শামিল। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২(শ) (১) ধারা মোতাবেক সম্পৃক্ত অপরাধ।

মিজানুর রহমানের অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে: দুই নাবালক পুত্রের নামে পরিচালিত ২৪টি স্থায়ী আমানতের আড়াই কোটি টাকা, যা ফ্রিজ অবস্থায় রয়েছে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে কোটি টাকা মূল্যের জমি, মিরপুরের টোলারবাগে ৯০০ থেকে ১৬০০ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল তিনটি গাড়ি, সহকর্মী রেজাউল করিমের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ঢাকা ও গাজীপুরে ৯.৪৮ কোটি টাকার জমি, তিনটি সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানে ৩.২৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং নিজ শহর পাবনায় কোটি টাকা মূল্যের ২১ কাঠা জমির ওপর এলপিজি ফিলিং স্টেশন। তার দুর্নীতি ও অনিয়মের অন্যতম অংশীদার রেজাউল করিমেরও অঢেল সম্পদের পাশাপাশি সন্দেহভাজন লেনদেনের তথ্য মিলেছে।

মো. মিজানুর রহমান রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড কোম্পানির সেক্রেটারি ও রানার মোটরস লিমিটেড ওয়ার্কার্স প্রফিট স্যাটিসফ্যাকশন ফান্ডের চেয়ারম্যান। দেশের বৃহৎ শিল্প ক্যাটাগরিতে ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার- ২০২০’ পাওয়া রানার গ্রুপের শীর্ষপদে আসীন এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তারপরও বহাল তবিয়তে তিনি! শুধু মিজানুর রহমান নন, একই প্রতিষ্ঠানের হেড অব সেলস মো. রেজাউল করিমের বিরুদ্ধেও অনৈতিক উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার তথ্য এসেছে।

মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দেশীয় ব্র্যান্ড রানার মোটরস লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রতিনিয়ত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন নানা কৌশলে। নিজ মালিকানায় নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান মমতা ফিশারিজ অ্যান্ড এস্টেট, ইশরা প্রোপার্টিজ লি. ও তাজ পোলট্রি অ্যান্ড ফিশারিজের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। শুধু অভিযোগ নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও মিজানুর রহমান ও রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে অঢেল সম্পদ, সন্দেহভাজন লেনদেন ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ মিলেছে।

যে কারণে বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের অনুমোদন নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একই সঙ্গে দুদকের উপপরিচালক মো. ইয়াছির আরাফাতের নেতৃত্বে একটি টিম কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে নথিপত্র তলব করে রানার গ্রুপ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে দায়িত্ব পালন করে তারা (মিজানুর রহমান ও রেজাউল করিম) দিনের পর দিন দুর্নীতি ও অনিয়মের খেলা চালিয়েছেন। যার অধিকাংশই মানি লন্ডারিং আইনে গুরুতর অপরাধ। এগুলো কীভাবে সম্ভব? এত অনিয়মের পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ! বিষয়টি আরও সন্দেহজনক।

মিজানুর রহমান ও রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পেছনের অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা থাকবে। গত পাঁচ বছরে মো. মিজানুর রহমানের নিজ নামে ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবের নথিপত্র বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে সন্দেহজনক, অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় অধিকতর তদন্তের আবশ্যকতা রয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিএফআইইউ’র গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, তিনি রানার গ্রুপে কাজ করার সুবাদে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিজানুর রহমান পাবনা শহরে ২১ কাঠা জমি এক কোটি টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপন করেছেন। স্ত্রী ও নিজ মালিকানায় ঢাকার মিরপুর- ১ এর ১/৯/৩-এ, টোলারবাগে একটি এবং ১৪/১, টোলারবাগ অভিজাত ভবনের দ্বিতীয় ও পঞ্চম তলায় সাড়ে ৯০০ থেকে ১৬০০ বর্গফুট আয়তনের চারটি ফ্ল্যাট ও কয়েখটি গাড়ির তথ্য পেয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে দুদকে পাঠানো চিঠি সূত্রে জানা যায়, রানার অটোমোবাইলস লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি ও রানার মোটরস লিমিটেড ওয়ার্কার্স প্রফিট স্যাটিসফ্যাকশন ফান্ডের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান এবং একই প্রতিষ্ঠানের হেড অব সেলস রেজাউল করিম কোম্পানির নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন।

তারা বিধিবহির্ভূতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মোটরযান ব্যবসার অর্থ ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করে নানা ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদে রূপান্তর করেছেন। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২ (শ) ধারা অনুসারে অপরাধ।