শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে অনিয়ম কিংবা কারসাজি নতুন কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অনিয়ম কিংবা কারসাজির মাত্রা চরমে। নানা কৌশলে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, সিকিউরিটিজ হাউজ কিংবা বড় ব্যাক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বশান্ত করার উৎসবে মেতে থাকে। তবে আশার কথা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন দায়িত্ব্য নেয়ার পর থেকেই পুঁজিবাজারে কারসাজি বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করায় শতাধিক ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠান ও সিকিউরিটিজ হাউজকে ৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে কমিশন। বিএসইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এসব ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জানুয়ারিতে আতা খান অ্যান্ড কোং-কে ১০ লাখ, আমান কটন ফাইব্রাসের চেয়ারম্যান মো: শফিকুল ইসলামকে ৩ কোটি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলামকে ৩ কোটি, পরিচালক তরিকুল ইসলামকে ৩ কোটি, পরিচালক তৌফিকুল ইসলামকে ৩ কোটি এবং অ্যালায়েন্স হোল্ডিংসকে ১ লাখ টাকাসহ মোট ১২ কোটি ১১ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।

ফেব্রুয়ারিতে ফ্যামিলি টেক্সের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে অনিয়ম করায় ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদের ফারুক ও তার আত্মীয়দের ২০ লাখ, ফার কেমিক্যালের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে অনিয়ম করায় ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদের ফারুক ও তার আত্মীয়দের ১৫ লাখ,

আরএন স্পিনিংয়ের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে অনিয়ম করায় ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদের ফারুক ও তার আত্মীয়দের ১০ লাখ এবং মেঘনা ব্যাংক সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মহিবুল্লাহকে ৫ লাখ টাকাসহ মোট ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

মার্চে একটিভ ফাইনের চেয়ারম্যান মো: জিয়া উদ্দীনকে ৫ লাখ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম সাইফুর রহমানকে ৫ লাখ, পরিচালক মো: আফজালকে ৫ লাখ এবং কোম্পানি সচিব মো: মাহবুবুর রহমানকে ৫ লাখ টাকাসহ মোট ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এপ্রিলে ওয়াইফাং সিকিউরিটিজকে ৩ লাখ, শ্যামল ইক্যুইটি ম্যানেজম্যান্টকে ৫ লাখ, আইআইডিএফসি ক্যাপিটালের বিনিয়োগকারী মেহনাজ বিন তাজিয়াকে ৫ লাখ এবং আব্দুল কাইয়ুম ও তার সহযোগীদের ৫০ লাখ টাকাসহ মোট ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

চলতি বছরের মে মাসে ইনটেক লিমিটেডের পরিচালক এটিএম মাহবুবুল আলমকে ১০ লাখ, পরিচালক মো: শহীদুল আলমকে ১০ লাখ, পরিচালক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদকে ১০ লাখ, পরিচালক আশিকুর রহমানকে ১০ লাখ, পরিচালক আরিফুর রহমানকে ১০ লাখ,

পরিচালক শামসুল আলমকে ১০ লাখ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর্জা আমিনুল ইসলামকে ১০ লাখ, ওয়ান সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মাকসুদা আহমেদকে ২ লাখ, ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজের বিনিয়োগকারী ফরিদ হোসেনকে ১ লাখ এবং এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেসের পরিচালক রেজাউর রহমানকে ৩ লাখ টাকাসহ মোট ৭৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

জুন মাসে প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজকে ৩ লাখ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে ৫ লাখ, আরএন স্পিনিংয়ের পরিচালক আব্দুল কাদের ফারুককে ৬০ লাখ, আরএন স্পিনিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মেজর একেএম হাফিজ আহমেদকে ৩৫ লাখ,

আরএন স্পিনিংয়ের চেয়ারম্যান (এমএল ডায়িংয়ের মনোনীত পরিচালক) হুমায়ুন কবিরকে ১০ লাখ, আরএন স্পিনিংয়ের পরিচালক কিম জং সুককে ১০ লাখ, আরএন স্পিনিংয়ের পরিচালক শিরিন ফারুককে ৫ লাখ, প্রআইম ইসলামী সিকিউরিটিজের সাবেক সিইও আবুল কালাম ইয়াজদানীকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এছাড়া শেয়ারবাজার কারসাজির মুল নায়ক খ্যাত সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভকে ৭২ লাখ, ইসি সিকিউরিটিজকে ১০ লাখ এবং ইসি সিকিউরিটিজের সিইও খুশীদ আলমকে ১০ লাখ টাকাসহ জুন মাসে মোট ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।

জুলাই মাসে ফ্যামিলি টেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: মোর্শেদকে ৫ লাখ টাকা, কনিকা আফরোজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে ৭৫ লাখ টাকা এবং আবুল খায়ের হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ মোট ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

আগস্টে সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরোর হাতে গড়া সমিতি ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও এর সহযোগীদের ৫৫ লাখ টাকা, হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের আরও ৩ কোটি টাকাসহ মোট ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সেপ্টেম্বর মাসে সিটি ব্রোকারেজের বিনিয়োগকারী এজি মাহমুদকে ১০ লাখ টাকা, একই হাউজের বিনিয়োগকারী সাইফ উল্লাহকে ১৫ লাখ, এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের বিনিয়োগকারী জসিম উদ্দীনকে ৫০ লাখ, ব্লুমিনেন্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টকে ৫ লাখ, স্বদেশ ইনভেস্টমেন্টকে ৫০ লাখ এবং বান্কো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক আব্দুল মুহিতকে ১ লাখ টাকাসহ মোট ১ কোটি ৩১ লাখ টাকার জরিমানা করা হয়।

অক্টোবরে সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরো ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। এছাড়াও সিটি ব্রোকারেজের বিনিয়োগকারী জাহিদুল আবেদিনকে ১ কোটি ২০ লাখ, সিটি ব্রোকারেজের বিনিয়োগকারী সাইফ উল্লাহকে ৮৩ লাখ, সিটি ব্রোকারেজের বিনিয়োগকারী এজি মাহমুদকে ৩ কোটি, সিটি ব্রোকারেজের বিনিয়োগকারী এসএম মোতাহারুল জানানকে ১৭ লাখ,

নিট কনসার্ন লিমিটেডের নাসার উদ্দীনকে ৫ লাখ, বিনিয়োগকারী শারমিন আক্তার লাভলীক ২ লাখ, বিনিয়োগকারী জসিম উদ্দীনকে ১ কোটি এবং অসাধী সিকিউরিটিজকে ৩ লাখ টাকাসহ অক্টোবর মাসে মোট ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এছাড়া নভেম্বর মাসে আলিফ অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টকে ৫ লাখ, এমিনেন্ট সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী জসিম উদ্দীন ও তার সহযোগীদের ৫০ লাখ টাকা, বাঙ্কো ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হামদুল ইসলামকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

পাশাপাশি বাঙ্কো ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হামদুল ইসলামের ভগ্নিপতি কাজী এমদাদুল হককে ৪ কোটি, বোন হোসনে আরা বেগমকে ৩ কোটি, শ্বশুড় আবদুস সুলতানকে ৩ কোটি, স্ত্রী শাহিদা আরাবিকে ২ কোটি, ভাই শফিকুল ইসলাম হেলালিকে ৪ কোটি টাকাসহ নভেম্বর মাসে মোট ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি।

এদিকে এই শতাধিক ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানের মতো আরও কিছু ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের নথি বিএসইসির হাতে রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তিদের মধ্যে অনেকেই নিজেরাই নিজেদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে ভূমিকা রেখেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএসইসি কর্মকর্তা বলেন, ‘আইন অমান্য করার কারণে বিএসইসি এরই মধ্যে বেশকিছু ব্রোকারেজ হাউজ ও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, যা আমাদের নিয়মিত কাজ। ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। ’

অনিয়মরোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অমান্য করার শাস্তি শুধুমাত্র সতর্ক করা কিংবা সামান্য জরিমানা হওয়া উচিত নয়। অনিয়মের মাধ্যমে যে পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছে, সে পরিমাণ বা তার বেশি অর্থ জরিমানা না করলে এসব কার্যক্রম থামানো যাবে না। কারণ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে অনিয়ম চলতেই থাকবে।

বিএসইসির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ব্রোকার হাউজগুলোর অনিয়মের দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গ্রাহকের অর্থ এফডিআর করে শর্ট ফল করে রাখা, ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ার ক্রয়ে মার্জিন ঋণ প্রদান, নির্ধারিত অনুপাতের অতিরিক্ত মার্জিন ঋণ প্রদান, ক্যাশ হিসাবে মার্জিন ঋণ সুবিধা প্রদান, গ্রাহকদের অর্থ ও শেয়ার প্রদান না করা, প্রদত্ত চেক প্রত্যাখান হওয়া,

শর্টসেল করাসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে অনেক সিকিউরিটিজ হাউজ। যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করে নিজেদের শেয়ারের বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর হ্রাস-বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগির পদক্ষেপ নেওয়া হবে।