শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: সোনালী পেপারের ইপিএস নিয়ে কারসাজির অভিযোগ তুলছেন বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিটির ইপিএস কারসাজি খতিয়ে দেখার দাবী করছেন বিনিয়োগকারীরা।বছরজুড়ে শেয়ার কারসাজির কোম্পানি সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ‘যেমন খুশি তেমন মুনাফা’ প্রকাশ করে চলেছে।

কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতেছেন পুঁজিবাজারের সবচেয়ে আলোচিত এক বিনিয়োগকারী, যিনি একজন সরকারি ক্যাডার কর্মকর্তা। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির এক পদস্থ কর্মকর্তার ছাত্র। যে কারণে তার বিরুদ্ধে কারসাজির অনেক অভিযোগের প্রমাণ মিললেও তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয় না। তার সঙ্গে বিএসইসির অনেক কর্মকর্তার ব্যবসায়িক যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সোনালী পেপারের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩০ জুন ২০২২ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে বা ৯ মাসে (জুলাই ’২১-মার্চ ’২২) কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখিয়েছিল ১৪ টাকা ৭২ পয়সা। কিন্তু অর্থবছরের চার প্রান্তিকে, অর্থাৎ ১২ মাসে চূড়ান্ত ইপিএস দেখিয়েছে ৬ টাকা শূন্য ৩ পয়সা।

অর্থাৎ অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফায় চমকের পর চমক দেখা যায়। কিন্তু শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) মুনাফা হওয়া তো দূরের কথা, শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৮ টাকা ৬৯ পয়সা। আবার চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ’২২) কোম্পানিটি ইপিএস দেখিয়েছে ৭ টাকা শূন্য ২ পয়সা।

প্রশ্ন হলো, আগের এপ্রিল-জুন ’২২ প্রান্তিকে কেন শেয়ারপ্রতি লোকসান হলো ৮ টাকা ৬৯ পয়সা; আবার ঠিক পরের প্রান্তিকেই অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর ’২২ প্রান্তিকে কীভাবে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হলো ৭ টাকা শূন্য ২ পয়সা—কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফায় চমকের পর চমক দেখিয়ে কোম্পানিটির শেয়ার দাম আকাশচুম্বী করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে শেয়ারটি গছানোর প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু তাতে খুব একটা সফল না হয়ে এবার রেকর্ড পরিমাণ ইপিএস দেখানো হলো। যাতে তাদের আকাশে তোলা শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপানো যায়।

দীর্ঘদিন ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে থাকার পর ২০১৯ সালের ২ জুলাই মূল মার্কেটে ফিরে সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস। মূল মার্কেটে লেনদেন শুরু হয় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে। শর্ত থাকে, পরবর্তী বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) পর্যন্ত ‘জেড’ ক্যাটাগরিতেই লেনদেন হবে কোম্পানিটির। এরপর কোম্পানিটি ২৫ অক্টোবর ২০১৯ সালের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরপর কোম্পানিটি ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হয়।

প্রসঙ্গত, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে লভ্যাংশকে বিবেচ্য বিষয় ধরা হয়। কোনো কোম্পানি যদি ১০ শতাংশ বা তার বেশি লভ্যাংশ দিয়ে থাকে, তখন সে কোম্পানিটির শেয়ার ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত উন্নীত হয়। আর যদি ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ প্রদান করে, তাহলে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে নিয়মিত লভ্যাংশ না দিলে এবং সিকিউরিটিজ আইন পরিপালনে ব্যর্থ হলে সে কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি ‘এন’ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়ে লেনদেন হয়।

সোনালী পেপার ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ায় ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি কোম্পানিটি ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়ে লেনদেন শুরু করে। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার ২৭৩ টাকায় ফ্লোর প্রাইস মাসের পর মাস বিক্রেতাশূন্য থাকে।

২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ২০০ টাকার নিচে নেমে যায়। তারপর সমান তালে চলে কোম্পানিটির মুনাফা ও শেয়ার দামে কারসাজি। যেখানে দুর্বল পারফরম্যান্সের কারণে কোম্পানিটি বছরের পর বছর ওটিসি মার্কেটে বন্দি ছিল, সেখানে ওটিসি মার্কেট থেকে ফেরার পর মুনাফায় চমকের পর চমক দেখা যায়।

প্রতি প্রান্তিকেই মুনাফায় আসে ঝলক। এর ফলে কোম্পানিটির শেয়ার দামেও দেখা যায় উল্লম্ফন। মাত্র ৯ মাসের কম সময়ের মধ্যে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৯৬০ টাকার ওপরে উঠে যায়। এ সময় কোম্পানিটি দুটি শেয়ারের বিপরীতে একটি রাইট শেয়ার ঘোষণা করে। সব শেয়ার নিজেদের কাছে থাকায় কৌশল করে এত উচ্চ দামের শেয়ারটির রাইট অফারও নির্ধারণ করা হয় ফেসভ্যালুতে, অর্থাৎ মাত্র ১০ টাকায়।

রাইট সাবস্ক্রিপশনের পর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অ্যাডাজাস্ট হয় ৫০০ টাকার নিচে। তারপর আবার চলে ধারাবাহিক কারসাজি। এর সঙ্গে সাপোর্টিং হিসেবে আসে কোম্পানিটির চমকানো মুনাফা। বর্তমানে শেয়ারটি দাম সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে টানাটানি চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ’২২) রেকর্ড মুনাফা দেখিয়ে শেয়ারটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে ওই কারসাজি ও কোম্পানিটির অসৎ কর্মকর্তারা।

সোনালী পেপার ১৯৭৭ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে এবং ১৯৮৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৬ সালে কোম্পানিটি ইউনুস গ্রুপ অধিগ্রহণ করে। কোম্পানিটি পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ উৎপাদন করে। এর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩৫ হাজার টন। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৩২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।