শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিতে প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বেড়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩টি লিজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। বিপরীতে কিছু বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে ৯টি থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির চিত্র দেখে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ খুব কম। আবার বাজারে সক্রিয় থাকা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ব্যক্তি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো ট্রেডারের ভূমিকা পালন করে। বাজার যখন নিম্নমুখী হয় তখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো বিক্রির চাপ বাড়ায়। আবার বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী হয় তখন শেয়ার কেনে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণের কারণে শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

তারা আরও বলছেন, শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এ ধরনের বিনিয়োগ বেশ কম। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর চিত্র দেখে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না। বিনিয়োগ করার আগে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের চিত্র দেখার পাশাপাশি কোম্পানির আর্থিকচিত্রও ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে।

বিশেষ করে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা কেমন, লভ্যাংশের চিত্র এবং কোম্পানি পরিচালনায় কারা আছেন, তা ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে। যদি কোম্পানি নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ দেয় এবং আয়ের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে ওই কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়া ভালো লক্ষণ- অভিমত শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে লিজিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে সবচেয়ে বেশি। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। এক মাস আগে অর্থাৎ জানুয়ারিতে কোম্পানিটির ৪১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল। এ হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিটির দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন করে কিনেছেন।

কোম্পানিটির বড় অংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকলেও এর আর্থিক অবস্থা ভালো না। লোকসানে নিমজ্জিত এই লিজিং কোম্পানিটি ২০১৩ সালের পর বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

বিআইএফসির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়া লিজিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিডি ফাইন্যান্স, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, আইডিএলসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্স।

এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার সবচেয়ে বেশি কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিটির ২ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার নতুন করে কিনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এতে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৭ দশমিক ২১ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দখলে রয়েছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বাড়ার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিডি ফাইন্যান্স। ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিটির ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ শেয়ার নতুন করে কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এতে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।

এর পরের স্থানে রয়েছে জিএসপি ফাইন্যান্স। ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিটির ১ দশমিক ৬২ শতাংশ শেয়ার নতুন করে কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এতে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়া লিজিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে- ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ে ১৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ, ফাস ফাইন্যান্সে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ১৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, আইডিএলসিতে ২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে ২৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে ২৪ দশমিক ২১ শতাংশ, আইপিডিসিতে ১৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ, লংকাবাংলায় ২১ দশমিক ৮৭ থেকে ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ে ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ থেকে ২৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্সে ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ।

অপরদিকে ফেব্রুয়ারিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ফিনিক্স ফাইন্যান্স থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে কোম্পানিটির তিন শতাংশের বেশি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এতে ফেব্রুয়ারি শেষে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ২৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে- উত্তরা ফাইন্যান্সে ৩২ দশমিক ৭৩ শতাংশ থেকে ৩২ দশমিক ৭০ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালে ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে ১৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ, প্রাইম ফাইন্যান্সে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্সে ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ, মাইডস ফাইন্যান্সে ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ২৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ইসলামিক ফাইন্যান্সে ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ, আইসিবিতে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ।

বে-লিজিংয়ের ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জানুয়ারিতে কোম্পানিটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কমেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৩০ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, সার্বিকভাবে দেশের বেশিরভাগ লিজিং কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো না। অনেকগুলো লিজিং কোম্পানি সমস্যার মধ্যে আছে। তবে এর মধ্যেও কিছু লিজিং কোম্পানি ভালো ব্যবসা করছে। যে কারণে লিজিং খাতের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটা আলাদা আগ্রহ আছে। বিশেষ করে কয়েকটি লিজিং কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে এবং আয়ের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা রয়েছে।

তিনি বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উচিত বিনিয়োগের আগে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়লো নাকি কমলো তা পর্যালোচনার আগে কোম্পানির আর্থিকচিত্র পর্যালোচনা করা। যদি কোম্পানির আর্থিক চিত্র ভালো হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও বাড়ে তাহলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সঠিক ভূমিকা পালন করে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটা ভূমিকা হলো বাজার স্থিতিশীল করা। কিন্তু তারাও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো যখন শেয়ারের দাম কমে যায় বিক্রির চাপ বাড়ায়, আবার দাম বাড়লে শেয়ার কেনে। তারা এমন আচরণ করলে তো বাজারে স্থিতিশীলতা থাকে না।

হঠাৎ কোনো খাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়া ভালো লক্ষণ কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করবে কোম্পানির আয় ও লভ্যাংশের ওপর। ভালো লভ্যাংশ দেয় না, এমন কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়লে অনেক সময় শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওই শেয়ার কিনলে পরবর্তীকালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।