শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি প্রিমিয়ার লিজিংয়ের আমানতকারীদের অর্থ লুটে পুটে খাচ্ছে। পাশাপাশি বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে হতাশ করছে। কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের টাকায় ব্যবসা করলেও সমাপ্ত অর্থবছর শেষে বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দিচ্ছে না। অথচ কোম্পানি ঠিকই ব্যবসা করেছে।

প্রিমিয়ার লিজিংয়ের কোম্পানির পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তবে প্রিমিয়ার লিজিংয়ের কোম্পানি ঘোষিত ডিভিডেন্ডে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন। ঘোষিত ডিভিডেন্ডের পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে একাধিক বিনিয়োগকারীরা।কারন কোম্পানিটি মুনাফা থাকা স্বত্বে নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করায় বিনিয়োগকারীরা তদন্তের দাবী জানিয়েছেন।

বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেছেন, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ঘোষিত ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করেছে। আর যদি প্রতারনা না করে তা হলে নো ডিভিডেন্ডের কারন কি? কোম্পানির মুনাফা থাকা স্বত্বেও নো ডিভিডেন্ড ঘোষনা করছে। এ কোম্পানির পরিচালকদের শাস্তির দাবী জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা ।

এদিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স লিমিটেড। টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানটির দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন আমানতকারীরা। বেশির ভাগকেই ফিরতে হচ্ছে শূন্য হাতে।

ব্যক্তিশ্রেণীর আমানতকারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ধারের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। মূল ঋণ পরিশোধ করতে না পারা প্রতিষ্ঠানটি এখন সুদ পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে। জাতীয় সংসদে প্রকাশিত ব্যাংকের ঋণখেলাপির তালিকায় যে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম স্থান পায়, তার একটি প্রিমিয়ার লিজিং।

আমানতকারীরা উদ্বেগে সময় পার করলেও উল্টো আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে দুশ্চিন্তায় রেখেছেন সেখান থেকে ঋণ নেয়া গ্রাহকরা। প্রিমিয়ার লিজিং থেকে ঋণ নেয়া বড় গ্রাহকদের প্রায় সবার নামই আছে খেলাপির খাতায়। এর মধ্যে চিহ্নিত ঋণখেলাপি যেমন আছেন, আছে দেশের নামকরা করপোরেট জায়ান্টও। এ তালিকায় আছে রহিমআফরোজ, নাভানা, সাইফ পাওয়ার টেক, ওয়েস্টার্ন মেরিন, বিশ্বাস টেক্সটাইল, মাহিদ এক্সপো, এসএ অয়েল, মোস্তাফা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম।

তবে ব্যক্তিশ্রেণীর আমানতকারীদের টাকা কিস্তিতে হলেও ফেরত দিচ্ছেন বলে দাবি করেছেন প্রিমিয়ার লিজিংয়ের শীর্ষ নির্বাহী আবদুল হামিদ মিয়া। তার ভাষ্য, প্রিমিয়ার লিজিং থেকে ঋণ নেয়া বড় গ্রাহকরা টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ওভার ডিউ হয়ে যাওয়া ঋণের ২০ শতাংশ অর্থও যদি ফেরত পাওয়া যেত তাহলে প্রিমিয়ার লিজিং ঘুরে দাঁড়াতে পারত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দেশের অনেক নামকরা শিল্প গ্রুপের কাছ থেকেও টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ব্যক্তিশ্রেণীর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে কিস্তিতে হলেও ধাপে ধাপে টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে।

কাগজে-কলমে প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ এক-তৃতীয়াংশ। যদিও বাস্তবতা বলছে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ অর্ধেকেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রিমিয়ার লিজিংয়ের তথ্য বলছে, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের প্রায় সব শীর্ষ গ্রাহকই নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক সাহাবুদ্দিন আলমের এসএ অয়েল লিমিটেডের কাছে প্রিমিয়ার লিজিংয়ের পাওনা রয়েছে ৪৯ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি হয়ে রয়েছে ঋণটি।

প্রিমিয়ার লিজিং থেকে ঋণ নিয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইব্রাহিম রেহেনা ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ৫১ কোটি, কেয়ার স্পেশালাইড হাসপাতালের ৫০ কোটি, মাহিদ এক্সপো ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইলের ৫৯ কোটি, বিশ্বাস টেক্সটাইলের ৪৭ কোটি, অ্যাডভান্স রেডিমিক্স কংক্রিট ইন্ডাস্ট্রির ৪১ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিনের ৩০ কোটি, এসএমসি গ্রুপের ১৭ কোটি, ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডের ২৭ কোটি, সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেডের ৩৯ কোটি, রহিমআফরোজের ৩৫ কোটি, নাভানা গ্রুপের ২৪ কোটি, কেবি ফুড লিমিটেডের ২২ কোটি এবং মোস্তফা গ্রুপের ১৯ কোটি টাকা নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়।

২০০১ সালে যাত্রা করা প্রিমিয়ার লিজিংয়ের মোট আমানত ৮০৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ঋণ ও লিজিং হিসেবে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বিনিয়োগকৃত অর্থের বড় অংশই ফেরত না পাওয়ায় আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রায় ৯০০ আমানতকারীর জমা আছে ৯৫ কোটি টাকার সঞ্চয়। আমানত হিসেবে রাখা এ অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। মোট ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা সম্পদের প্রিমিয়ার লিজিং ঋণ, মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করেছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রাহকদের বিশ্বাসের ঘাটতি শুধু প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স লিমিটেডের নয় বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া। তিনি বলেন, পিপলস লিজিং অবসায়নসহ নানা কারণে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গ্রাহকরা আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। মানুষ এখন আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাকা রাখতে চাচ্ছে না। কারণ অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানতের টাকা যথাসময়ে ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শুধু অনিয়ম-দুর্নীতিই এর একমাত্র কারণ বলে মনে করেন না তিনি।

তার ভাষ্য, দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের শুরু থেকে। তার আগের বছরগুলোতে আমানত ও ঋণ প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের মিসমেস ছিল। এর প্রভাবে ব্যাংকগুলোকেই তারল্য সংস্থানে হিমশিম খেতে হয়েছে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একেবারেই সুখকর নয়। তবে বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংকটের শুরু হয়েছে খেলাপি ঋণ থেকে। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলে দেশের বহু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে হারিয়ে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সূত্র মতে, আলোচিত সময় কোম্পানির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ১.০৬ টাকা। যা আগের বছর একই সময় ছিল ১.১৬ টাকা। এছাড়া শেয়ার প্রতি সমন্বিত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ১৪.৪৪ টাকা এবং শেয়ার প্রতি নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) ২.৮৫ টাকা।

কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আগামী ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট ১১ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছে। এজিএমের সময় ও স্থান পরে জানানো হবে বলে কোম্পানি পক্ষ থেকে জানানো হয়।