শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: করোনাভাইরাস শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ এর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে৷ চাকরি হারাতে পারেন বহু মানুষ৷করোনাভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ৷ স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড৷

জেপি মর্গান, বলছে পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে৷ চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের চেয়ে অর্ধেক কমে যাবে, জানিয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি৷

ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ এই অভিঘাত বাংলাদেশের ওপর কতটা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে বিশ্লেষকদের চুলছোড়া বিশ্লেষন।

এছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে চীনের অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যটন ক্ষেত্রে চীন ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সে প্রভাব গিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে বড়ো অর্থনীতির দেশসহ দেশের পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব এড়াতে পারছে না বাংলাদেশও।

করোনা ভাইরাসের ফলে বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ধস নেমেছে চীনের শেয়ারবাজারেও। এ ভাইরাস বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় চীন ভ্রমণে সতর্ক থাকার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে ফ্লাইট, হোটেল বুকিং বাতিল করছে পর্যটকরা। এদিকে চীনের অর্থনীতির ১১ শতাংশ নির্ভর করে পর্যটন খাতের ওপর।

চীনের অন্যতম জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহ ক্ষেত্র উহান শহর নিষিদ্ধ থাকায় জ্বালানি কেনা কমিয়ে দিয়েছে। আবার ফার্মাসিউটিক্যালস, আর্থিক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসে চীনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া চিকিৎসা খাতে চীনের বাড়তি ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার। ফলে এই ভাইরাস চীনের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতে বড়ো প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

করোনা ভাইরাসে চীনের পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির। বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৩৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। তবে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বন্ধ রয়েছে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি।

এদিকে করোনা মোকাবিলায় ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি থাকায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোও বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় কোম্পানিগুলো মুনাফার ধারাবাহিকতা কিভাবে বজায় রাখবে, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে কোম্পানিগুলোর মুনাফার পাশাপাশি লভ্যাংশের ধসের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের রফতানি খাতের সিংহভাগ পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই এর প্রভাবও পুরো রফতানি বাণিজ্যের ওপর পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানিগুলো। কারণ করোনার জন্য উৎপাদন বন্ধ থাকায় কোম্পানিগুলোর পণ্য রফতানি করতে পারছে না। এই মুহূর্তে অধিকাংশ কোম্পানির অর্ডারও বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতের ৫৬টি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত রয়েছে, যার সিংহভাগই রপ্তানিমুখী।

এছাড়া তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও পুঁজিবাজারের ভ্রমণ, অবকাশ, সেবা ও আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই দুই খাতে তালিকাভুক্ত মোট ৯টি কোম্পানি রয়েছে। আরও বেশ কিছু খাতে পরোক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর সার্বিক প্রেক্ষাপটে এসব প্রভাব ব্যাংক খাতের ওপর প্রভাব বর্তাবে বলে ধারণা করছেন তারা।

এদিকে, করোনা দীর্ঘদিন থাকলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন হবে, সে বিষয়টি বাজার-সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে। ইতোমধ্যে সরকার সাধারণ ছুটির মেয়াদ চতুর্থ দফা বাড়িয়ে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে। ফলে করোনার প্রভাবে ধারাবাহিক দরপতনের মুখে যেসব বিনিয়োগকারী ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা শেষ পুঁজিটুকু ফিরে পাবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘যেসব দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি করা হয় সব দেশই করোনায় আক্রান্ত। ফলে সামগ্রিকভাবে বহির্খাতে যে পারফরম্যান্স, সামনের দিকে তার নেতিবাচক প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি সমস্যায় পড়েছে। তাদের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহম্মেদ বলেন, করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি কোম্পানিগুলোর উপর। করোনা প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে হলে পুঁজিবাজারের অনেক কোম্পানির ভবিষ্যতে ডিভিডেন্ড দিতে হিমশিম খাবে। এছাড়া বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিগুলোর উপর পরিমাণ মুনাফার প্রত্যাশা করেছিল, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন। তবে কিছু খাত এর ব্যতিক্রম হতে পারেও বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘করোনার প্রভাবে পোশাক খাতে সর্বোচ্চ বিপর্যয় দেখা দেবে। আরও দুই মাস রফতানি কার্যক্রম বন্ধ থাকার আশঙ্কা রয়েছে। কোম্পানিগুলো সামনের দিকে যে পরিমাণ মুনাফার প্রত্যাশা করেছিল, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এর প্রভাব পড়বে কোম্পানির মুনাফা ও লভ্যাংশের ওপরও।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বঅর্থনীতি লন্ডভন্ড দশায় উপনীত হতে শুরু করেছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দেশগুলোর অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও তৈরী পোশাক রফতানির উপর ভর করে প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বিগত দশকের অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

প্রায় ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। এমনই সন্ধিক্ষণে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব ও হিমশীতল মৃত্যুর আতঙ্কের মধ্যে বাংলাদেশ। এছাড়া করোনার প্রভাবে সব কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাব কতদিন স্থায়ী হবে, তা কেউই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। এতে রফতানির্ভর পোশাক খাতের ওপর বেশি প্রভাব ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।’