শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও দিশেহারা অবস্থা বিনিয়োগকারীদের। কারণ, টানা দরপতনে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এসব কোম্পানির শেয়ারের দামও কমেছে বেশি। এ কারণে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো মানের বাছাই করা ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকটি প্রায় অর্ধযুগ আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার দিন শেষে ডিএস-৩০ সূচকটি ১০ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে ১ হাজার ৪৯৯ পয়েন্টে, যা প্রায় ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি এ সূচক ১ হাজার ৪৭৮ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। চলতি বছরের পুরোটা সময়ে টানা দরপতনের ফলে এ সূচক সবচেয়ে বেশি পেছনের দিকে ফিরে গেছে।

ডিএস-৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারের সবচেয়ে ভালো কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃত। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য এসব কোম্পানিতেই বেশি বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু সেগুলোর দামই এবারের দরপতনে সবচেয়ে বেশি কমেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্চের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগে টানা নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ বিনিয়োগই ডিএস-৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোতে। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রি বেড়ে যাওয়া মানে এসব শেয়ারের বিক্রিও বেড়ে যাওয়া, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামেও।

এদিকে ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। ক্রেতা না থাকায় লেনদেন তলানীতে নেমে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছেন। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শেয়ার কিনছে না। এতে একদিকে লেনদেন কমছে, অন্যদিকে পতন হচ্ছে সূচকের।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের লাভজনক কয়েকটি কোম্পানি অংশ নিলে শেয়ারবাজার চাঙা হবে। একইসঙ্গে আইনের শাসন কঠোরভাবে প্রয়োগের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করছেন তারা।

গত সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ৫৮ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কমেছে। এই সময়ে ডিএসইতে লেনদেন কমেছে গড়ে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। শুধু তাই নয়, চলতি ডিসেম্বরে লেনদেন হওয়া ১৪ দিনের মধ্যে ১০ দিনই সূচকের বড় ধরনের পতন হয়েছে। যে চারদিন বেড়েছে তা খুবই সামান্য। সব মিলিয়ে ডিসেম্বর মাসে ডিএসইএক্স ২৭৪ পয়েন্ট হারিয়েছে। নভেম্বর শেষে এই সূচক ছিল ৪ হাজার ৭৩১ পয়েন্ট। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) তা ৪ হাজার ৪৫৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারে চলছে আস্থা ও তারল্য সঙ্কট। আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের কারণে। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অনেক কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়ায় অর্থ পাচার হয়েছে। তাই বর্তমান কমিশনের পুনর্গঠন ছাড়া গতিশীল হবে না পুঁজিবাজার।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মো. রকিবুর রহমান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘ক্রমাগত দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা এই বাজারের প্রতি আস্থা পাচ্ছেন না। ছোট-বড় কোনও বিনিয়োগকারীই এই বাজারে আস্থা পাচ্ছেন না। এ থেকে উত্তরণে ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে হবে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)।’
তিনি বলেন, ‘ভালো কয়েকটি কোম্পানি বাজারে আনার পাশাপাশি সরকারের লাভজনক কমপক্ষে ৬টি কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। এর সঙ্গে যদি আইনের শাসন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, তাহলে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য।’

ডিএসই শেয়ারহোল্ডার পরিচালক উল্লেখ করেন, ‘গ্রামীণফোনের মতো ভালো শেয়ার বাজারে এলে তার সঙ্গে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীও বাজারে আসবেন। লাভে থাকা সরকারি কোম্পানি বাজারে এলে মানুষ শেয়ার কেনার প্রতি আগ্রহী হবেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তখন শেয়ার কেনার প্রতি আগ্রহী হবে।’

বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, ‘গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির সৃষ্ট ঝামেলা শুধু গ্রামীণফোনের ক্ষতি করেনি, মার্কেটের কাঠামোও ধ্বংস করেছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশিরা যখন শেয়ার কেনেন তখন তারা মূল ভিত্তি দেখেন। যখন তারা শুনেছেন টাকার ডিভ্যালুয়েশন হবে, তখন তারা গ্রামীণফোনের সঙ্গে অলিম্পিক, স্কয়ার ফার্মা, ইউনাইটেড পাওয়ার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো সব বিক্রি করে দিচ্ছে। শুধু এসব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার ফলে গত দুই মাসে দেশের পুঁজিবাজারে অনেক সূচক কমেছে।’

এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারের চলমান সঙ্কট দূর করার জন্য সবার আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি মানুষের বিশ^াসযোগ্যতা কমে যাওয়ার কারণেই বাজারে বিপর্যয় ঘটছে। তাই বিএসইসিকে ভেঙে নতুন করে ঢেলে সাজালে চাঙ্গা হতে পারে দেশের পুঁজিবাজার।

এছাড়া ‘গ্রামীণফোন ও বিটিআরসি ইস্যুতে পুঁজিবাজার টালমাতাল। দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। আর আস্থা সংকট না কাটলে বাজার ইতিবাচক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। তিনি বলেন, প্রণোদনা দিলে বাজার সাময়িকভাবে উপকৃত হয়। এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়।

পুঁজিবাজারের করুণ দশা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর থেকে কোনো পদক্ষেপেই বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি; বরং দিন দিন তলানিতে নেমে গেছে সূচক ও লেনদেন। ধারাবাহিক পতনের ফলে বাজার দীর্ঘদিন ধরে লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। মাঝেমধ্যে সূচক বাড়ে সেটা লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যক্তির মতো চোখ মেলে তাকানো। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিশ্চিত করে বলা যায় না কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লোকসান হবে না অথবা মুনাফা হবে। একটি চক্র কৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের ইচ্ছামতো বাজার ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী হয়। প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণে নেই এ দেশের পুঁজিবাজার।

প্রসঙ্গত, গত কয়েক মাস ধরেই দেশের পুঁজিবাজারে ক্রমাগত দরপতন চলছে। লেনদেন শুরু হলেই পড়তে থাকে সূচক। আগের সপ্তাহের মতোই গত সপ্তাহেও বাজারে বড় দরপতন হয়। গত সপ্তাহ শুরু হয় পতনের মধ্য দিয়ে। সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ডিএসইএক্স ১৬ পয়েন্ট পড়ে যায়। সোমবার বিজয় দিবসের ছুটি ছিল। মঙ্গলবার ৭৯ পয়েন্ট পড়ে যায়। বুধবার ডিএসই সূচক পড়েছে ২ পয়েন্টের মতো। তবে সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বা প্রধান সূচক ৩৮ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট বেড়ে ৪ হাজার ৪৫৬ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে।