শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: নতুন সরকার গঠনের সাত পেরিয়ে গেলেও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। একদিন বাজার ভাল গেলে পরের দিনই খারাপ। এই পরিস্থিতির মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। অভিযোগ রয়েছে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মুন্নু গ্রুপের শেয়ারের কারসাজির পর অস্বাভাবিক দরপতন শেয়ারবাজারকে আরও অস্থির করে তুলছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে কারসাজি চক্র জড়িত। তারা অস্বাভাবিকভাবে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের দর বাড়িয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন কোম্পানি দুইটি বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা।

ঐ চক্রটি ফের মুন্নু সিরামিকস ও মুন্নু স্টার্ফলাস নিয়ে নতুন করে কারসাজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর মুন্নু গ্রুপের শেয়ার কারসাজির মুল হোতা শীর্ষ দুই ব্রোকারেজ হাউজ। ঐ দুই শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজ তদন্ত করলেও থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। ঐ চক্রটি নতুন করে বাজার থেকে টাকা লোপাট করার ধান্ধায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

মাত্র দেড় বছরের মধ্যে মুন্নু স্ট্যাফলার্সের শেয়ার দর ৪০০ টাকা থেকে ৫৬৩৪ টাকায় এবং মুন্নু সিরামিকের শেয়ার দর ৪০ টাকা থেকে ৪৪১ টাকায় তুলেছিল একটি কারসাজি চক্র। কোম্পানি দুটির শেয়ার দরে উল্লম্ফন ঘটিয়ে সেই চক্রটি পুঁজিবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে চড়া দরে কোম্পানি দুটির শেয়ার কিনে পুঁজিহারা হয়ে পথে বসেছিল হাজার হাজার বিনিয়োগকারী।

এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত কমিটি গঠন করে কারসাজিকারীদের শাস্তিও দিয়েছিল। কিন্তু শাস্তির মাত্রা কেবল লোক দেখানো হয়েছিল বিধায় কারসাজিকারীদের দমানো যায়নি। বরং তারা আরও বেসামাল হয়ে নবরূপে আর্ভিভূত হচ্ছে। কোম্পানি দুটির শেয়ার নিয়ে ফের অসাধু চক্রটি নতুন কারসাজির খেলায় মেতে উঠেছে বলে বিনিয়োগকারীরা ও বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন। এ কারসাজিতে কোম্পানির মালিক পক্ষ বরাবরই জড়িত রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জুলায়ের শেষদিকে মুন্নু স্ট্যাফলার্সের শেয়ার দর ছিল ৪০০ টাকার নিচে এবং মুন্নু সিরামিকের শেয়ার দর ছিল ৪০ টাকার নিচে। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর মুন্নু স্ট্যাফলার্সের দর উঠে ৫৬৩৪ টাকায় এবং ২০১৯ সালের ৩ মার্চ মুন্নু সিরামিকের শেয়ার দর উঠে ৪৪১ টাকায়।

এ সময় কোম্পানি দুটির কিছু মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও প্রকাশ পায়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোম্পানি দুটির ভবিষ্যত স্বপ্নে বিভোর হয়ে শেয়ার দুটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর এ সুযোগে কারসাজিকারিরা ও মুন্নু কর্তৃপক্ষ তাদের শেয়ার দেদারছে বিক্রি করতে থাকে। তাদের শেয়ারের সেল প্রেসারে কোম্পানি দুটির শেয়ার দরে আচমকা পতন নেমে আসে। অব্যাহত পতনের এক পর্যায়ে গত ২১ জুলাই মু্ন্নু স্ট্যাফলার্সের শেয়ার দর ৬৫০ টাকার নিচে এবং মুন্নু সিরামিকের শেয়ার দর ১২০ টাকার নিচে নেমে যায়।

তবে পরের দিন (২২ জুলাই ২০১৯) থেকে কোম্পানি দুটির শেয়ার দরে আবারও তেজিভাব ফিরে আসে। গত ১০ কার্যদিবসে মুন্নু স্ট্যাফলার্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৪১৩ টাকা বা ৬৪.৪৩ শতাংশ এবং মুন্নু সিরামিকের শেয়ার দর বেড়েছে ৯৬ টাকা বা ৮০.৯৩ শতাংশ। জুলাই মাসে কোম্পানি দুটির শেয়ার একাধিক কর্মদিবস ক্রেতা সংকটের মুখে পড়লেও গত ১০ কর্মদিবসে কোম্পানি দুটির শেয়ার একাধিক কর্মদিবস বিক্রেতা সংকটের মুখে পড়তে দেখা যায়।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৮ সালের ৩০ জুন তারিখে মুন্নু স্ট্যাফলার্সের উদ্যোক্তাদের শেয়ার ছিল ৫৫.৯০ শতাংশ। যা ৩০ জুন ২০১৯ তারিখে কমে দাঁড়ায় ৪২.৯৮ শতাংশে। অর্থাৎ এ সময়ে কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা ১২.৯২ শতাংশ শেয়ার বা ২ লাখ ৬৭ হাজার উদ্যোক্তা শেয়ার বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এতে বাজার দরে উদ্যোক্তারা ৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে, গত ২০১৮ সালের ৩০ জুন তারিখে মুন্নু সিরামিকের উদ্যোক্তাদের শেয়ার ছিল ৬২.৪০ শতাংশ। যা ৩০ জুন ২০১৯ তারিখে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭.৫৮ শতাংশে। অর্থাৎ এ সময়ে কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা ৪.৮২ শতাংশ শেয়ার বা ১৫ লাখ ৭৪ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা শেয়ার বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে বাজার দরে কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা ৫৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্সের শেয়ার দর উল্লম্ফনের পেছনে কোম্পানির কিছু পরিচালক ও কর্মকর্তা জড়িত। সাথে রয়েছে ব্যক্তি শ্রেণীর কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারী।

মুন্নু গ্রুপের উভয় কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে এবং একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দোষীদের শাস্তিও হয়েছে। তারা বলছেন, মুন্নু গ্রুপের দুই কোম্পানির মতো পুঁজিবাজারে অন্য কোন কোম্পানির ক্ষেত্রে এতো অধিক সংখ্যক ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়নি।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে কোম্পানির চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ মুন্নু মারা যাওয়ার পর কোম্পানি দুইটির দায়িত্বে আসেন তার মেয়ে বিএনপি নেতা আফরোজা খানম রিতা। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। কোম্পানির পর্ষদে এই পরির্বতন আসার পর থেকেই ৩৮ টাকার মুন্নু সিরামিক ৪৪১ টাকা ও ৪০০ টাকার মুুন্নু স্ট্যাফলার্স ৫৬৩৪ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। নতুন নেতৃত্ব আসার পর থেকেই কোম্পানির মুনাফা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর বাড়তে থাকে। কিন্তু এক পর্যায়ে মুন্ন সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স টানা দরপতন হয়।

মুন্নু সিরামিকস ও মুন্নু স্ট্যাফলার্সের এ দরপতনে কোম্পানির পরিচালক থেকে শুরু করে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা জড়িত। বাজারে গুজব রয়েছে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স বড় দরবৃদ্ধির পেছনে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হাত ছিল। এছাড়া একাধিক ব্যক্তি শ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারী জড়িত ছিল।

জানা গেছে, গত ১৩ মার্চ মুন্নু সিরামিকের মুনাফায় উল্লম্ফন ও শেয়ার দরে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ। মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। এর মূল উদ্দেশ্য কোম্পানির একটি করপোরেট পরিচালকের শেয়ার বিক্রি।