dse-up-dowenমোবারক হোসেন, ফাতিমা জাহান, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা : পুঁজিবাজারে দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশি সময় ধারাবাহিক দরপতনের পর গত দুই মাস ধরে বাজারের ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। বাড়ছে লেনদেনের পরিমান তেমনি অচল পোর্টফোলিও সচল হচ্ছে। দৈনিক লেনদেনের পাশাপাশি বাড়ছে সূচক।

নীতি-নির্ধারনী মহলের সমন্বয়, স্টেকহোল্ডারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বাজার ইস্যুতে সরকারের আন্তরিক মনোভাব ও বিএসইসির ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে উর্ধ্বমুখী প্রবনতা বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে স্টক ডিলার, সিকিউরিটিজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, বীমা কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ অর্থ আবারো বাজারে প্রবেশ করছে। এছাড় পুঁজিবাজারের উর্ধগতিতে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা। পাশাপাশি নতুন নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিক দরপতনে যেসব বিনিয়োগকারীরা বাজারবিমুখ ছিলেন সেসব বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হচ্ছেন। এ অবস্থায় মাইনাসে থাকা অচল পোর্টফোলিওগুলোও শিগগিরই সচল হবে এমন প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান বাজারে সার্বিক বাজার পরিস্থিতির যে ইতিবাচক ধারাবাহিকতা রয়েছে তা অব্যাহত থাকলে অসংখ্য বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও লেনদেনের যোগ্যতা ফিরে পাবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারের ২০১০ সালের মহাধসের পর লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মাইনাসে চলে যায়। মার্জিন লোন গ্রহণকারী প্রায় সব বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও মাইনাসে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারসহ নীতিনির্ধারণী মহলের পক্ষ থেকে সব মার্জিন লোন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ফোর্সসেল বন্ধ রাখতে মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়। ফোর্সসেল বন্ধ থাকলেও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মূল্য সূচক ২০১১ এবং ২০১২ সালে যথাক্রমে প্রায় ৩০ এবং ২০ শতাংশ কমে যায়। এর ফলে মাইনাসে থাকা পোর্টফোলিওগুলোর অবস্থা আরো অবনতি হয়। যে কারণে মাইনাসে থাকা পোর্টফোলিওগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অচল পড়ে থাকে।

পাশাপাশি গত সাড়ে ৩ বছরের বেশি সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রদত্ত ডিভিডেন্ড গ্রহণ করেও বিনিয়োগকারীরা তাদের লোকসান কাটাতে পারেননি। বরং ৪ বছর পর পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারের দর গৃহীত ঋণের চেয়ে অনেকাংশে কমে যায়। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মূলধন হারিয়ে সংশ্লিষ্ট হাউজের কাছে আরো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অর্থাৎ পোর্টফোলিওতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করলেও ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিনিয়োগকারীর দায় থেকে যায়। বাজারের বর্তমান ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগকারীদের অনেকে ক্রয় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।

যদিও ধসের পর কয়েকবার একই ধরনের প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিলেন এসব বিনিয়োগকারী। কিন্তু প্রতিবারই তারা আশাহত হয়েছেন। কারণ, সূচক উত্থানের পর পতনের পর্যায়ে যাবার আগে এসব বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও মাইনাসেই ছিল। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি এবং সরকারসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সক্রিয় ভূমিকার কারণে এবারের উত্থানে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা তুলনামূলক বেশি।

তেমনি পুঁজিবাজারের প্রতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় দিন দিন বাড়ছে বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লি: (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের (২০১৬) সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি (২০১৭) পর্যন্ত পাঁচ মাসে বিনিয়োগকারীরা নতুন ৩৭ হাজার ৮২৪টি বিও হিসাব খুলেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী ২৮ হাজার ৪৭০ জন এবং প্রবাসী ৮ হাজার ৮১১টি জন নতুন বিও হিসাব খুলেছেন। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোও নতুন ৫৫৩টি নতুন বিও হিসাব খুলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত বিও হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখ ৪৯ হাজার ৯৩টি। যা গত বছরের আগস্ট মাস শেষে ছিল ২৯ লাখ ১১ হাজার ২৬৯টি। এর মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব ২১ লাখ ৪২ হাজার ৫৩টি।

\যা আগস্ট শেষে ছিল ২১ লাখ ১৩ হাজার ৫৬২টি। অর্থাৎ আলোচিত সময়ে পুরুষ বিনিয়োগকারীরা ২৮ হাজার ৪৯১টি নতুন বিও হিসাব খুলেছেন। ২২ জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত নারী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাবের সংখ্যা ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৯১৮টি। যা এর আগের বছর আগস্ট মাস শেষে ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার ১২৮টি। অর্থাৎ আলোচিত সময়ে নারী বিনিয়োগকারীরা ৮ হাজার ৭৯০টি নতুন বিও হিসাব খুলেছেন। সচলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত একক বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪০ হাজার ২১টি। যা গত বছরের আগস্ট মাস শেষে ছিল ১৮ লাখ ১৪ হাজার ২২৯টি।

অর্থাৎ একক বিও হিসাব বেড়েছে ২৫ হাজার ৭৯২টি। পাশাপাশি জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫০টি। যা এর আগের বছর আগস্ট মাস শেষে ছিল ১০ লাখ ৮৬ হাজার ৪৬১টি। অর্থাৎ যৌথ বিও হিসাব বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৯টি। বর্তমানে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ২৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৪টি এবং প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৭টি।

এছাড়া কোম্পানির অধীনে বিও হিসাব রয়েছে ১১ হাজার ১২২টি। যা এর আগের বছর আগস্ট মাস শেষে ছিল যথাক্রমে ২৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৬৪টি, ১ লাখ ৪১ হাজার ৪২৬টি এবং ১০ হাজার ৫৬৯টি। সেই হিসেবে এর সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ২৮ হাজার ৪৭০টি, ৮ হাজার ৮১১টি এবং ৫৫৩টি। ২০১০ সালের মহা ধসের পর বিও হিসাবের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমেছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে দেশের শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লাও হালকা হয়ে আসছে। তাই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। এর জেরেই নতুন বিও হিসাব খোলার হারও বেড়েছে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী বলেন, দেশী বিদেশী সকল স্তরের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এসেছে, ফলে বাজার রয়েছে স্থিতিশীল। এ স্থিতিশীলতা বজায় রেখে বাজার সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এছাড়া সরকার পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত করতে দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তাতে বর্তমান বাজার সম্পর্কে তাদের ভালোভাবে দীক্ষা দেয়া হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগের কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

আহমেদ রশীদ লালী আরো বলেন, বিও হিসাব ফি এবং বিভিন্ন চার্জ কমিয়ে নতুন নীতিমালা জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাই বিও হিসাব খোলার হার বেড়েছে। এ মূহুর্তে বাজার সংশ্লিষ্টদের একটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বাজার সংশ্লিষ্টদের সকল আইন সঠিকভাবে পরিপালন করলে এ স্থিতিশীলতা ধরে রাখা যাবে। আর এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সকলকে সজাগ থাকার জন্য নির্দেশও দিয়েছে।

একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের কর্মকর্তারা জানান, সূচকের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবে ৬ হাজারের ঘরে উঠলে অনেক বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট মাইনাস থেকে প্লাসে চলে আসবে। এতে তারা লেনদেনে সক্রিয় হবার সুযোগ পাবেন। গত প্রায় ৪ বছরের বেশি সময় ধরে লেনদেন করতে না পারা বিনিয়োগকারীরা তাই লেনদেনে সক্রিয় হবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এছাড়া দিন দিন বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বাড়া বাজারের জন্য ইতিবাচক দিক।

একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, নানামুখী খবরে বিদায়ী বছরের মাঝামাঝি থেকে পুঁজিবাজার গতিশীল রয়েছে। এটা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। ধারাবাহিক উত্থানের কারণে দেশের শেয়ারবাজার অনেকটাই বিনিয়োগ উপযোগী হয়ে উঠেছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীলতা থাকায় দেশের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ফলে প্রতিদিনই বাজারে যোগ হচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এসেছে। কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে। যা বাজারের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। যদিও বর্তমান বাজারে কতিপয় কোম্পানির দর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারপরও এভাবে বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারলে বাজারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে।