all bank lagoশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো শেয়ারের মূল্য বাড়াতে কৃত্রিম উপায়ে বেশকিছু ব্যাংক অতিরিক্ত মুনাফা দেখিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খেলাপি ঋণের উচ্চ বোঝা, অলস টাকার পাহাড় ও ভয়াবহ আর্থিক কেলেংকারির মধ্যেও পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি সন্দেহজনক বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এ প্রেক্ষিতে প্রতিটি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে বিবি মাঠে নেমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা বাড়িয়ে দেখানো ‘জোক অব দ্য ইয়ার’ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিটরা। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর কৃত্রিম মুনাফা বৃদ্ধি শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া কিছ্ইু নয়। গ্রাহক আকর্ষণের হাতিয়ার হিসেবে বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং খাতের যে আচরণ ছিল তার সঙ্গে মুনাফার কোনো মিল নেই।

সংশ্লিষ্ট সুত্র মতে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা দেখানোর ক্ষেত্রে কোন কারসাজি করছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সমাপ্ত বছরে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়ে যাবার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। খুব শিগগিরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০ থেকে ১২টি দল মাঠে নেমে মুনাফার বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।

জানা গেছে, খেলাপি ঋণ গোপন করে অথবা বাড়িয়ে মুনাফা দেখানোর মাধ্যমে কোন ব্যাংক বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে কিনা তা পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে, অতিরিক্ত মুনাফা দেখালে কয়েকটি ক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাব পড়ে। প্রথমত বেশি মুনাফা করলে পুঁজিবাজারের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শেয়ারের দর চাঙ্গা হয়। এতে প্রতারিত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আমানতকারীরাও ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আমানত রাখতে প্রলুব্ধ হন। এর সরাসরি সুবিধাভোগী হন ব্যাংক পরিচালকরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, অতীতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ গোপন করাসহ নানা কারসাজির আশ্রয় নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি থাকে ওই ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত মুনাফা তত কমে যায়। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা মেনে চললে কোন ব্যাংকের বেশি মুনাফা হবার কথা নয়।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা রয়েছে। ফলে ব্যাংকের কাছে অলস পড়ে আছে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। উচ্চ সুদের কারণে কেউ বিনিয়োগে আসছেন না।

ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে কমায়নি। এখনও সুদের হার ১২ থেকে ১৬ শতাংশ। এর বাইরে রয়েছে উচ্চ সার্ভিস চার্জ। ছিল বিভিন্ন আর্থিক কেলেংকারি। তবুও ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৫টির পরিচালন মুনাফার প্রাথমিক চিত্র পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে ৩৫টি ব্যাংক প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে, যা ২০১৫ সালে ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে সরকারি রূপালী ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তবে ২০১৫ সালে ২৮২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে সব তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে হিসাব করেছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির লোকসান ছিল ২৪০ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা কমে ১০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

তবে ২০১৬ সালে বেসিক ব্যাংক পরিচালন মুনাফা দেখিয়েছে ১৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যদিও ব্যাংকটি গত ৩ বছর লোকসানে ছিল। বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার মো. ইকবাল বলেন, গত ৩ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম আমরা লাভের মুখ দেখেছি। নতুন করে সরকার কিছু বন্ড দেয়ার কথা ভাবছে। বন্ডগুলো ছাড় পেলে আগামী বছর মুনাফা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও মুনাফার শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি বিদায়ী বছরে মুনাফা করেছে রেকর্ড ২০০৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল এক হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একক ব্যাংক তার পরিচালন মুনাফা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়াল। এর আগে কোনো ব্যাংকের মুনাফা এটা অতিক্রম করেনি।

জানা গেছে, ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য আয় আসে এলসি কমিশন থেকে। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র স্থাপন করে ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য মুনাফা করে। কিন্তু বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটের পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে।

এদিকে ৩১ ডিসেম্বরের ক্লোজিং হিসাব অনুযায়ী মুনাফার দিক থেকে শীর্ষ কয়েকটি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার ৩ কোটি টাকা, আগের বছরে ছিল এক হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৮৪৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের ৯২২ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৭৮০ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফা ৮৬৩ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৮৩৩ কোটি টাকা।

ইউসিবিএলের ৮১৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৮৪০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির গত বছরের তুলনায় মুনাফা কমে গেছে। সিটি ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭৫৬ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৬৯১ কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের চেয়ে কমে গেছে। ব্যাংকটি আগের বছরে মুনাফা ছিল ৭৮৫ কোটি টাকা, যা বিদায়ী বছরে কমে ৭২০ কোটি টাকা হয়েছে। এক্সিম ব্যাংক ৬৯০ কোটি টাকা মুনাফা করে নবম হয়েছে।

আগের বছরে ছিল ৬৫০ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে মুনাফা কমে গেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। ব্যাংকটি বিদায়ী বছরে মুনাফা করেছে ৬৩০ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৬৪৩ কোটি টাকা। এবি ব্যাংক এবার মুনাফা করেছে ৫৮০ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৫০২ কোটি টাকা।

বিদায়ী বছরে প্রাইম ব্যাংক ৬২৫ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৬০৫ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ৫৯০ কোটি, এবি ব্যাংক ৫৮০ কোটি, মার্কেন্টাইল ৫০৮ কোটি ও ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।

এছাড়া ঢাকা ব্যাংক ৪৭০ কোটি, এনসিসি ৪৭০ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৪৫১ কোটি, আইএফআইসি ৪৩০ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ৩৭৫ কোটি, মিউচুয়াল স্ট ৩৬০ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৩৫০ কোটি ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৩১৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।

২০১৬ সালে ১৭০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা হয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের। আগের বছর ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৯৪ কোটি টাকা। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ১৫৪ কোটি টাকা। আগের বছর যা ছিল ৮০ কোটি টাকা। ফারমার্স ব্যাংকের মুনাফা ৬৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।

মিডল্যান্ড ব্যাংক মুনাফা করেছে ১১২ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৭৮ কোটি টাকা। তবে মধুমতি ব্যাংকের মুনাফা ১০২ কোটি টাকা থেকে কমে ৯২ কোটি টাকা হয়েছে। এনআরবি ব্যাংক মুনাফা করেছে ৯৩ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ছিল ৩৯ কোটি টাকা।

আমানতকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ, খেলাপি ঋণের প্রভিশন ও সরকারের প্রাপ্য কর যখন পরিশোধ করা হবে তখন উল্লিখিত অনেক ব্যাংক লাভের পরিবর্তে লোকসানে পড়ে যাবে। তবে এসব খরচ বাদ দিলেও প্রতিবারের মতো ইসলামী ব্যাংক লাভে থাকবে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পরিচালন মুনাফা কৃত্রিম উপায়ে দেখানো হয়েছে। সব খরচ বাদ দিলে এটা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটাকে মুনাফা না বলে ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের আংশিক চিত্র বলা যায়। তিনি বলেন, উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। আমানতের সুদ ২ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে একদিকে গ্রাহককে ঠকানো হচ্ছে, অন্যদিকে ঋণের সুদ এখনও ১০ থেকে ১৬ শতাংশে আটকে আছে। তার মতে, ব্যাংকগুলো সাময়িক গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে পরিচালন মুনাফা বেশি দেখিয়ে থাকতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বেসিক ব্যাংকের মুনাফা দেখানো ‘জোক অব দ্য ইয়ার’। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে বোঝা যায় ব্যাংকগুলোর দেখানো পরিচালন মুনাফা সঠিক নয়। তার মতে, মুনাফা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। কারণ ব্যাংকিং ব্যবসা ভালো ছিল না। অসৎ ঋণ গ্রহীতার কারণে ভালো ঋণ গ্রহীতারা ছিল ব্যাংকের কাছে জিম্মি। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে শেয়ারের মূল্য বাড়াতে কৃত্রিম উপায়ে মুনাফা বাড়িয়ে থাকতে পারে ব্যাংকগুলো।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতে কিছুটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। কারণ কোনো কোনো ব্যাংক ‘আগাম মুনাফা’ সমন্বয় করে মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাছাড়া পরিচালন মুনাফা প্রকৃত মুনাফা নয়। খেলাপি ঋণের প্রভিশন, লভ্যাংশ ও সরকারকে কর দেওয়ার পর যে অর্থ থাকবে, তাই নেট মুনাফা। পরিচালন মুনাফা দেখে গ্রাহকরা প্রতারিত হতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।