শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়সহ নানা কারণে ডুবতে বসেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়েছে। জানা গেছে, যেখানে অন্য কোম্পানিগুলো প্রিমিয়াম আয়ের ৩২ শতাংশ ব্যয় করে ব্যবস্থাপনা খাতে, সেখানে সানলাইফ নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যয় করেছে ৫৭ শতাংশ। দীর্ঘ সময় ধরে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণহীন ব্যয়ের ফলে কোম্পানির আর্থিক ভিত একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেছে।

জানা যায়, কোম্পানি এই সংকটের মধ্যে অতিরিক্ত দামে জমি ও ফ্ল্যাটসহ বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনেয়োগ করেছে। যে কারণে দীর্ঘ সময় ধরে লোকসানে ডুবে আছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০১৩ সালে তালিকাভুক্তির পর থেকেই বছরের পর বছর মুনাফা করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যেসব খাতে বিনিয়োগ করেছে তার পুরোটাই ছিল অলাভজনক। আর্থিক দুরবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানটিকে সাম্প্রতিক সময়ে অধিগ্রহণ করেছে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

লাভজনক খাতে বিনিয়োগ না করায় প্রতিষ্ঠানটির আয় তলানিতে পৌঁছেছে। এতে বছরের পর বছর ধরে দাবি নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়েছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক এবং তার পরিবারের সদস্যদের সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার ছিল ৩৫ শতাংশ। তাদের হাতে থাকা পুরো শেয়ার তারা গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড কাছে সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন।

সূত্র বলছে, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স যেসব খাতে বিনিয়োগ করেছে এগুলোর মধ্যে জমি ক্রয় অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির জমি ক্রয়ে বেশ অসংগতি দেখা গেছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনায় যেসব খরচ করা হয়েছে, তাতেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।

তথ্যে দেখা যায় ২০১৫ সালে জীবন বিমা খাতের গড়ে বিনিয়োগ ছিল ৬ শতাংশ। তবে অস্থির শেয়ারবাজারে সানলাইফের বিনিয়োগ ছিল ১৬ শতাংশ। এদিকে ২০১৫ সালে বিমা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেজারি বন্ডের বিনিয়োগ ছিল ৪৭ শতাংশ। তবে এ খাতে সানলাইফের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একটি বিস্তৃত ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়েছে। বিমা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য মোট বিনিয়োগের আছে ৩৪ শতাংশ। কিন্তু সানলাইফের স্থায়ী আমানতে মাত্র ১৬ শতাংশ বিনিয়োগ লক্ষ্য করা গেছে।

২০১৫ সালে শেয়ার, ট্রেজারি বন্ড এবং ফিক্সড ডিপোজিটে সানলাইফের বিনিয়োগ ছিল ৫৪ শতাংশ। এ বিনিয়োগ ২০২১ সালে ২৯ শতাংশে নেমে আসে। প্রতিষ্ঠানটি জীবন বিমা তহবিলের বৃহত্তর অংশ ২০২১ সালের মধ্যে জমি এবং ফ্ল্যাটে ক্রয়ে বিনিয়োগ করে। এ বিনিয়োগ থেকে খুব লাভবান হতে পেরেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স।

কোম্পানির একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, মালিকদের ব্যবস্থাপনায়, শেয়ার বাজারে ব্যাপক ক্ষতি এবং স্বজনপ্রীতির কারণে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসায় ধস নেমেছে। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২০১৫ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় ছিল ২১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা কমে ৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। একই সময়ে বিমা শিল্পে বিনিয়োগ থেকে আয় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

এদিকে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সানলাইফের ব্যবস্থাপনা বাবদ ব্যয় ৫০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বেশি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে অন্য সব জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে ৩২ টাকা ব্যয় করেছে ব্যবস্থাপনায়। এ ক্ষেত্রে সানলাইফের ব্যবস্থাপনা ব্যয় ছিল ৫৭ শতাংশ।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যয় করতে গিয়ে প্রিমিয়ামের বড় একটি অংশ খরচ করেছে। এতে বিনিয়োগ থেকে আয় হ্রাস পেয়েছে। ২০১৬ সালের পর থেকে সানলাইফের ব্যয় তার আয়কে ছাড়িয়ে যায়। এরপর পরিস্থিতি আর কখনোই উন্নত হয়নি। ২০২১ সালে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম এবং বিনিয়োগ থেকে ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যবস্থাপনা এবং দাবি নিষ্পত্তির জন্য ব্যয় করেছে ১৪৫ টাকা। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি ঘাটতিতে পড়ে যায়। এ ঘাটতি আর পূরণ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এস এম জিয়াউল হক বলেন, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো যখন তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে, তখন তারা সমস্যায় পড়ে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেও ছোট কোম্পানিগুলো পারে না। গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের একটি উদ্ভাবনী গবেষণা গ্রুপ রয়েছে। তারা সানলাইফকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে পারবে বলে মনে হয়। গ্রিন ডেল্টা জীবন বিমার ব্যবসায় আসার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। কারণ নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতের তুলনায় জীবন বিমা খাতের সম্ভাবনা বেশি রয়েছে।

তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। একই সময়ে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর আয় হয়েছে ১০ হাজার ১৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ে ভালো ব্যবসা করতে পারে। এ জন্য সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে গ্রিন ডেল্টা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ক্রয় করেছে।

শেখ কবির হোসেন জানান, ‍তিনি সানলাইফের অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছেন, তাদের দাবি পূরণ করা হচ্ছে না। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তাদের অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। তিনি এসব অভিযোগের কথা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) জানিয়েছেন। মালিকানা পরিবর্তনের আগে বিষয়টি সানলাইফের পরিচালনা পর্ষদকেও জানিয়েছিলেন। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি বলে তিনি জানান।