শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে দেশের বাইরে গত দুই বছর ধরে রোড শো করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এসব রোড শো’র মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগের রিটার্নসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে বিএসইসির এমন আয়োজনের পরও সম্প্রতি তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেছে।

বহুজাতিক কোম্পানির (এমএনসি) শেয়ার বিক্রি করে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ডিএসই দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। মুলত পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমায় বাজার সংশ্লিষ্টরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিকে দুষছেন।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লোর প্রাইস জারি করে পুঁজিবাজারকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। ফলে বিদেশে রোড শো করলেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া অধিকাংশ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে।

বাজারে লেনদেন হচ্ছে না এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। একই সঙ্গে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। তাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় হচ্ছে বেশি। এসব কারণে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বরের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৪ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটির শেয়ারের দাম ২০২৩ সালে সারা বছর ফ্লোর প্রাইস বা ন্যূনতম শেয়ারমূল্যে আটকে ছিল। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের মতো বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার এক বছরের বেশি সময় ধরে ফ্লোর প্রাইসের আটকে আছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশের অবস্থাও একই রকম। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমবে বলে তিনি মনে করেন।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সিঙ্গার বাংলাদেশ, ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেড, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বাটা সু, আরএকে সিরামিকস, রবি, গ্রামীণফোন এবং লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড।
এর মধ্যে যে পাঁচটি কোম্পানি সারা বছর ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল, এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা দুটি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। অপর তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে বাকি ৯টি বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে সাতটিতে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। একটিতে বেড়েছে এবং একটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ অপরিবর্তিত রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা তোলার সুযোগ কমে যাওয়ায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে। পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ধরে রাখতে হলে শুধু তাদের জন্য আলাদা নিয়ম-নীতি করতে হবে। সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নিয়ম একই হওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।

অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনেকাংশে দায়ী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মুনাফা কমে যাওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে ফ্লোরে দাম আটকে থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের মোট শেয়ারের দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারে দাম ১ হাজার ৮২০ টাকার মধ্যে অবস্থান করেছে। ২০২৩ সালে কোম্পানির শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ১ হাজার ৯৩০ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এপ্রতিষ্ঠানের দশমিক ২৪ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন।

একই অবস্থা সিমেন্ট খাতের আরেক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ কোম্পানির মোট শেয়ারের দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল বিদেশিদের হাতে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে দশমিক ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেডের মোট শেয়ারের অন্তত দশমিক ২৯ শতাংশ ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তা দশমিক ১১ শতাংশে নেমে এসেছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের মোট শেয়ারের ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের মোট শেয়ারের ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের নভেম্বরে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৮২ শতাংশ।

রেকিট বেনকিজার (বাংলাদেশ) পিএলসি এবং গ্রামীণফোন লিমিটেডের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এই দুটি কোম্পানির মোট শেয়ারের যথাক্রমে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং ২ দশমিক ১৩ শতাংশ ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বরের এটি যথাক্রমে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ প্রদানকারী কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ২০২৩ সালে সারা বছর ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে আটকে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশিরা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে অংশীদারত্ব কমিয়ে দেয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএটি বাংলাদেশের মোট শেয়ারের ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ বিদেশিদের হাতে ছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৬ দশমিক ০৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

দেশের জনপ্রিয় জুতা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডও এই সময়ে বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাটা সু কোম্পানিতে বিদেশিদের ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল। তবে তাদের অংশগ্রহণ দশমিক ০১ শতাংশ কমে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

এদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মোট শেয়ারের যথাক্রমে ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল। তবে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশিদের শেয়ার বেড়ে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং ২৮ দশমিক ৯১ শতাংশ হয়েছে।

তবে আরএকে সিরামিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্যতিক্রম চিত্র। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির কোনো বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল দশমিক ২৩ শতাংশ।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির মোট শেয়ারের যথাক্রমে দশমিক ২০ শতাংশ এবং দশমিক ১০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছিল। এই দুটি প্রতিষ্ঠানে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিদেশিদের অংশগ্রহণ একই রকম ছিল।