শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানিতে একের পর এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটছে। বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি কোম্পানি পরিচালনায় করা হয়েছে নানা অনিয়ম। এমনকি নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি এমন কোম্পানি সচিব দিয়ে বোর্ড সভার নোটিশ পাঠানোর মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সেই সঙ্গে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব পালনেও বাধা সৃষ্টি করার অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন বিল-ভাতার নামে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে চেকের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসব চেকে সই করছেন কোম্পানিটির দু’জন পরিচালক ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ও শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল। এদের একজন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মেয়ে এবং অপরজন আরেক মেয়ের জামাই।

সর্বশেষ গত ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ৪টি চেকে ৭৫ লাখ ৭৯ হাজার ৯২৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। কোম্পানিটির শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মালিবাগ চৌধুরীপাড়া ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট থেকে এসব টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। চেকগুলোতে সই করেছেন কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ও পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল।

এর মধ্যে আশরাফ-উল সোয়েটার (প্রাইভেট) লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু করা হয় ৭২ লাখ টাকার চেক। অ্যাকাউন্ট পেয়িং এ চেক ইস্যু করা হয় গত ২৬ ডিসেম্বর। এ টাকা রেন্যুয়াল গিফট (সোয়েটার) ক্রয়ের বিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ সংক্রান্ত নোট শিটে। একইদিন আরেকটি চেক ইস্যু করা হয় ইমপেরিয়াল স্যুটস অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টারের নামে।

এ চেকে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে নেওয়া হয় ৮৪ হাজার ১২৮ টাকা। ইমপেরিয়াল স্যুটস অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টারের নামে আরও দু’টি চেক ইস্যু করা হয় পরদিন ২৭ ডিসেম্বর। একটি চেকে ১ লাখ ৮৪ হাজার ২০০ টাকা এবং আরেকটি চেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৬০০ টাকা তোলা হয় সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তহবিল থেকে। অতিথিদের নাস্তা-খাবারের বিল পরিশোধ বাবদ চেক ইস্যু করা হয়েছে বলে নোট শিটে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া গত ৬, ১২ ও ২০ ডিসেম্বর ১৫টি নোট শিটে নেওয়া হয়েছে সোনালী লাইফের ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১৩৪ টাকা। এসব নোট শিটে কোম্পানিটির নথি উত্থাপনকারী কর্মকর্তা, সিনিয়র ম্যানেজার, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তাদের সই থাকলেও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কোনো সই নেই। সবগুলো নোট শিটে-ই অনুমোদন করা হয়েছে বিমা কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার সইয়ে। এদিকে সোনালী লাইফের আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

বিনিয়োগ ছাড়াই চেয়ারম্যান হওয়া, পরিবারের সদস্যদের পরিচালক বানানো এবং ফ্লোর ক্রয়ের অনুমোদনের আগেই কোম্পানির তহবিল থেকে অর্থ নেওয়াসহ বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে এ নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর অডিট ফার্ম হুদাভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোং-কে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। সোনালী লাইফের ১৭টি বিষয়ে তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছে আইডিআরএ।

২০১৮ সালে কোম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল বৃদ্ধির জন্য পরিচালকরা কোম্পানির শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত দেন। প্রকৃতপক্ষে কতজন পরিচালক কতটি শেয়ার ক্রয় করেন এবং এ জন্য কত টাকা পরিশোধ করেন তা যাচাই করা। কোম্পানির এফডিআর’র বিপরীতে সাউথ বাংলা ব্যাংকে এসওডি হিসাব নম্বর: ০০০২৬২২০০০০৭৩ খোলা এবং ওই ঋণ হিসাব হতে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও একই ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর- ০০০২১৩০০০০৩৩৪ হতে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে মোট ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ৪ জন পরিচালকের শেয়ার ক্রয়ের মূল্য পরিশোধের অভিযোগ যাচাই করা।

২০২২ সালে কোম্পানির বোর্ডে পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে একই পরিবারের ৪ জন সদস্যের নামে বিপুল সংখ্যক শেয়ার বিনামূল্যে হস্তান্তর করে পরিবারের সর্বাধিক সদস্যকে পরিচালক রাখার অভিযোগ যাচাই করা। ২০২৩ সালে কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (ড্রাগন সোয়েটার) প্রতি মাসে ঋণের কিস্তি বাবদ ৩ কোটি টাকা কোম্পানির হিসাব থেকে জনতা ব্যাংকে পরিশোধ করার বিষয় যাচাই করা।

বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ভবন কোম্পানির জন্য ক্রয়ের নামে কোম্পানির এফডিআর’র বিপরীতে সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক হতে ১৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া এবং এ জন্য ৩ বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বেশি সুদ দেওয়ার বিষয় পরীক্ষা করা।

বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ইমপেরিয়াল ভবন কোম্পানি কর্তৃক ৩৫০ কোটি টাকায় ক্রয়ের জন্য করা সমঝোতা চুক্তি যাচাই। আইডিআরএ’র অনুমতি ছাড়াই ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর সময়ে ইমপেরিয়াল ভবনের মূল্য বাবদ বর্তমান চেয়ারম্যানের ৫৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা গ্রহণের বিষয় পরীক্ষা।

বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ইমপেরিয়াল ভবনের জমির মালিকানা ও ভবন নির্মাণের রাজউক ও অন্যান্য সংস্থার যথাযথ অনুমোদন যাচাই। কোম্পানি থেকে ২০২১-২৩ সালের মধ্যে মোট ৬১ কোটি ৬২ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করে বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর বিষয় যাচাই। কোম্পানির পরিচালকরা অবৈধভাবে মাসিক বেতন-ভাতা হিসেবে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সময়কালে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে এরূপে আরও অর্থ নেওয়ার বিষয় যাচাই।

আইডিআরএ’র সার্কুলার অমান্য করে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বিলাসবহুল অডি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৩৬৯৫) ক্রয় এবং ২০২১-২৩ মেয়াদের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ করা বিপুল ব্যয় পরীক্ষা। চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্য পরিচালকরা কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশের অতিরিক্ত লভ্যাংশ গ্রহণের বিষয় যাচাই। কোম্পানির চেয়ারম্যানের বিদেশে চিকিৎসার যাবতীয় খরচ, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ভ্রমণ ও শপিং খরচ, বিদেশে পড়াশোনার খরচ অবৈধভাবে কোম্পানির তহবিল থেকে নির্বাহের বিষয় যাচাই।

কোম্পানির একজন পরিচালক (শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল)-এর ব্যক্তিগত অফিস কোম্পানির ভেতরে থাকা, গ্রুপ বিমা পলিসি থেকে বড় অঙ্কের কমিশন গ্রহণ এবং ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পরিচালক না হয়েও বোর্ড সভায় অংশগ্রহণ, সম্মানি-বোনাসসহ বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ এবং ব্যাংক হিসাবের সিগনেটরি থাকা যাচাই করা।

কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান ২০১৪ সাল থেকে ব্যক্তিগত ঋণ সমন্বয়, বিজিএমইকে অনুদান, এসি ক্রয়, বিনোদন (পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিবাহের উপহার), দুপুরের খাবার ও সন্ধ্যার নাস্তার বিল, কোরবানির গরু ক্রয়সহ (২০২২ সালে) ব্যক্তিগত খরচ, ২০২২ ও ২০২৩ সালে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় (১ কোটি ৯২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা) আইপিও খরচের নামে অতিরিক্ত টাকা (১ কোটি) এবং পলিসি নবায়ন উপহার বাবদ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ১ কোটি ২৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ইত্যাদি অর্থ কোম্পানি থেকে আত্মসাৎ করার বিষয় যাচাই করা।

বর্তমান চেয়ারম্যানের ১৫তলা ভবনে বিভিন্ন অফিস/প্রতিষ্ঠান ভাড়া থাকা সত্ত্বেও সব ইউটিলিটি বিল কোম্পানি থেকে পরিশোধ এবং ২০২১ সাল থেকে ইমপেরিয়াল ভবন কোম্পানি কর্তৃক পুরোপুরি ব্যবহার না করা সত্ত্বেও চেয়ারম্যান অবৈধ প্রভাবের মাধ্যমে পুরো ১৫ তলা ভবনের ভাড়া সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড থেকে পরিশোধের বিষয় যাচাই করা।

কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যানের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিংয়ের ২০২১ সালের ট্যাক্স বাবদ (১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা) সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড হতে পরিশোধের বিষয় যাচাই করা।

আইডিআরএ থেকে এ নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পর কোম্পানিটির সিইও মীর রাশেদ বিন আমানকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) তিনি কোম্পানিটির মালিবাগের বর্ধিত কার্যালয়ে প্রবেশ করতে গেলে তাকে বাধা সৃষ্টি করা হয়। ভবনের লিফট বন্ধের পাশাপাশি মুখ্য নির্বাহীর অফিস কক্ষও তালাবদ্ধ রাখা হয়।

এমনকি সোনালী লাইফের ই-মেইল ও ইআরপিতে লগইন করতে দেওয়া হচ্ছে না কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী মীর রাশেদ বিন আমানকে। এ ছাড়াও কোম্পানিটির তহবিল থেকে টাকা উত্তোলনে যুক্ত করা হয়েছে নতুন সিগনেটরি। তবে এসবের কোনোটির জন্যই কোম্পানিটির বোর্ড সভা বা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এ ঘটনার পর মীর রাশেদ এক সপ্তাহের ছুটিতে গেছেন বলে জানা গেছে।

এর আগে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি এমন কোম্পানি সেক্রেটারিকে দিয়েই সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বোর্ড মিটিংয়ের নোটিশ পাঠানো হয়। বোর্ড মিটিংয়ের ওই নোটিশের ৫ নম্বর এজেন্ডায় উল্লেখ করা হয়- কোম্পানি সেক্রেটারির নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের ৪৮তম মিটিংয়ের এ নোটিশ পাঠানো হয় গত ২৮ ডিসেম্বর। এর দু’দিন পর ৩১ ডিসেম্বর ওই মিটিং অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে সেই তারিখ পরিবর্তন করে আগামী ১৩ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে।

সোনালী লাইফের মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনের ১৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোম্পানি থেকে ইস্যু করা নোটিশে সই করবেন কোম্পানির ম্যানেজার, সেক্রেটারি অথবা পরিচালকদের দ্বারা নিয়োগ করা অন্যকোন অফিসার এবং এ সই হতে হবে লিখিত, মুদ্রিত অথবা স্বাক্ষরের ছবি’।

এ বিষয় সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য নিতে সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর বিমা কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজের পরিচয় পেয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে চাননি।