শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বছরের পর বছর চলে আসা মন্দার আরও একটি বছর পার হলো পুঁজিবাজারে। তবে এবার পতন কৃত্রিমভাবে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে ফ্লোর প্রাইস নামে প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দিয়ে। অর্থনীতির চাপের মধ্যেও ভালো ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোর শেয়ার একটি জায়গায় আটকে আছে বছরজুড়ে, নেই ক্রেতা।

ফলে বছরজুড়ে ভয়াবহ পতনের মধ্যে কাটিয়েছে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পাওয়া দূরে থাক অনেকে নিজেদের মূলধনও বাঁচাতে পারছেন না। শেয়ারের দর কমে এখন তলানিতে ঠেকেছে। বছর শেষেও কোনো সুখবর পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানা উদ্যোগের পরও চরম অস্থিরতায় ছিল পুঁজিবাজার। পুরো বছর পুঁজিবাজারের সূচক, লেনদেন, মূলধন উত্তোলনে এক ধরনের সংকট দেখা গেছে।

বাজার থেকে কোম্পানির মূলধন সংগ্রহের পরিমাণ কমে আগের বছরের চেয়ে ৩ ভাগের ১ ভাগে নেমেছে। বাজারের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তা কেউ জানে না। তবে এর মধ্যেও বছরের পর বছর লোকসান দেওয়া এমনকি উৎপাদন বন্ধ থাকা কয়েকটি কোম্পানির দর কোনোটা বেড়ে চার গুণ হয়েছে, কোনোটা হয়েছে ১০ গুণ। অখচ বছর শেষে ঐসব কোম্পানিগুলো নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ডলার সংকটের সঙ্গে মিলেছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। সরকারের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে পুঁজিবাজার। বাজার পরিস্থিতির উন্নতি করতে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। চলতি বছরজুড়েই একটানা দরপতনে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে।

গত বছর থেকে ডলার সংকট হলে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ পতন শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস (দর কমার নির্ধারিত সীমা) আরোপ করে। এরপর বাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তবে চলতি বছরের গত জুনের আগের বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলেও এরপর ফের পতনের দিকে ছুটে চলেছে পুঁজিবাজার।

অনেকে বলছেন, ২০১০ সালের পর এত বড় লোকসানে পড়তে হয়নি যা বর্তমান ধসের কারণে হয়েছে। বিএসইসি বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিনিয়োগ ধরে রাখতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে অনেকেই দিশাহারা। প্রতিদিনই শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।

পতনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানিগুলোও। লোকসান কমাতে দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। চলমান দরপতনের পেছনে যুক্তিসংগত কারণ নেই বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরাও। তারা বলছেন, টানা দর পতনের কারণে ভালো মৌল ভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ার দাম অবমূল্যায়িত হচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্ট ও বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বাজার আটকে রাখতে চাইছে সরকার। নির্বাচনের পর বাজার নিয়ে চিন্তা করবে। অন্যদিকে বিদেশে ডলার চলে যাবে এ আশঙ্কায় বহুজাতিক কোম্পানির লভ্যাংশ বিতরণ বন্ধ রয়েছে। তবে এর আগে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু প্রণোদনা বাজারে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এর কোনো কিছু দীর্ঘমেয়াদে কাজে আসেনি। বর্তমানে অলিখিতভাবেই চিহ্নিত কয়েকটি সিন্ডিকেট বাজার ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব পালন করছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, মোটা দাগে বাজারে দুটি সংকট। চাহিদার দিক থেকে সংকট হলো-এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। ক্রেতা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। সর্বশেষ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন ছিল চরমভাবে নিম্নমুখী। চলতি সপ্তাহের পাঁচ দিনের তিন দিনই দরপতন হয়েছে ডিএসইতে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরজুড়ে কারসাজিতে লোকসানী খান ব্রাদার্সের শেয়ারের দর ১০ টাকা থেকে ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে, পাঁচ বছর পর উৎপাদনে ফেরা এমারেল্ড অয়েল ২৮ টাকা থেকে ১৮৭ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, ৬২ টাকা থেকে ২৩২ টাকা পর্যন্ত উঠেছে শ্যামপুর সুগার। ১০ টাকার খুলনা প্রিন্টিং ৩০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এমন আরও অনেক কোম্পানি আছে।

এর পেছনে কারসাজি জড়িত, তা বোঝে সবাই, কিন্তু তাদের ধরা যায় না। অথচ ভালো মৌল ভিত্তি কোম্পানি বিএটিবিসি, স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোন, লাফার্জহোলসিম, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মতো শক্তিশালী কোম্পানির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে অবস্থান করছে।

বছরজুড়েই বাজারে ছিল লেনদেনে খরা। দুই বছর আগে যে বাজারে দিনে আড়াই হাজার বা তিন হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো, এখন গোটা সপ্তাহেই এই পরিমাণ লেনদেন হয় না। কমেছে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তির সংখ্যা বা আইপিওর মাধ্যমে পুঁজি উত্তোলন। স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউসের মুনাফায় ধস নেমেছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় আটকে গেছে বিনিয়োগ। মার্জিন ঋণের সুদের ভারে পিষ্ট হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

বছরের শুরুর দিন দেশে বেনিফিশিয়ারি ওনার বা বিও হিসাব ছিল ১৮ লাখ ৬১ হাজার ৭২২টি। বছর শেষের দিকে তা নেমে এসেছে ১৭ লাখ ৭২ হাজারের ঘরে। অর্থাৎ এক বছরে বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে ৮৮ হাজারের বেশি। ২০২৩ সালে শুধু ১২ কর্মদিবসে লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

তবে সিংহভাগ সময়েই লেনদেন আবর্তিত হয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার ঘরে। ২০০ কোটি টাকার নিচেও নেমেছে একাধিক দিন। একটি বৃত্তে ঘুরতে থাকা সূচকে বছর শেষে যোগ হয়েছে ৫০ পয়েন্টের মতো। তবে তাতে সিংহভাগ বিনিয়োগকারীর লোকসান ছাড়া কিছুই হয়নি।
কমেছে ব্রোকারেজ হাউস ও স্টক এক্সচেঞ্জের মুনাফাও।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ২৫ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) মুনাফা কমেছে ১২ শতাংশ। মন্দা বাজারে কমেছে আইপিওর সংখ্যাও। বিদায়ী বছরে মিডল্যান্ড ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স পুঁজিবাজার থেকে ৮১ কোটি টাকা তুলেছে। আগের বছর ৬টি প্রতিষ্ঠান তোলে ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা।