মেহেদী হাসান, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: আলাদিনের চেরাগের মতো পুঁজিবাজারের মাধ্যমেও রাতারাতি বড় লোক হওয়া যায়, সেই কল্পিত কথাই যেন সত্যি করে দেয়ার ব্রত নিয়েছে পুঁজিবাজারের ৫ কোম্পানি। গত এক মাসের মধ্যেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে কোনটার ১৬৫ শতাংশের বেশি । এখন পুঁজিবাজারে ৫ কোম্পানি ২০২২ সালে আলাদিনের চেরাগে পরিনত হয়েছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে কেউ কেউ রাতারাতি কোটি কোটি টাকা মালিক বনে গেছেন।

মুলত পাঁচ কোম্পানির শেয়ার গুজবে হু হু করে বাড়ছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ১৬৫ শতাংশ পর্যন্ত দর বাড়ছে। তবে এ হু হু করে দর বাড়ার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে সবাই নিরব। কোম্পানির পক্ষ থেকে বলছে, দরবৃদ্ধির কোন কারণ নেই। তা হলে কেন দর বাড়ছে। মুলত কি কারসাজি চক্রের কারণে দর বাড়ছে।

এই কোম্পানিগুলোর গন্তব্য কোথায়? প্রশ্ন বাজার সংশ্লিষ্টসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। এছাড়া সংবেধশীল তথ্য ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলছে পাঁচ কোম্পানির শেয়ারদর। একাধিকবার ডিএসই থেকে সতর্ক করার পরও লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরের।  এমন অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধি পাওয়া এই পাঁচ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে: ওরিয়ন ইনফিউশন, ইস্টার্ণ হাউজিং, মেট্রো স্পিনিং, আরএসএমস্টিল এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টম্যান্ট লিমিটেড।

মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই, মৌলভিত্তিতেও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। তারপরও ওষুধ খাতের ছোট কোম্পানি ওরিয়ন ইনফিউশনের দর গত এক মাসে ১৬৩ শতাংশ বেড়েছে। ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা মুনাফায় উল্লম্ফনের মতো কোনো সংবাদ না থাকলেও শুধু কারসাজির মাধ্যমেই শেয়ারটির দর বাড়ানো হচ্ছে।

শুধু ওরিয়ন ইনফিউশন নয়, সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে দর বাড়ছে ইস্টার্ন হাউজিং, মেট্রো স্পিনিং, এপেক্স ফুডস, আরএসআরএম স্টিল, পেপার প্রসেসিং, ন্যাশনাল পলিমার, ন্যাশনাল টি, এডভেন্ট ফার্মাসহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের। কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারদর বাড়ানো হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি পাওয়া এসব শেয়ার যখন কারসাজির চক্রগুলো বিক্রি শুরু করবে তখন ওই শেয়ারগুলোর সঙ্গে বাকি শেয়ারেরও দরপতন শুরু হতে পারে। এতে করে বাজারে আবারও অস্থিরতা তৈরি হবে, যাতে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

ব্রোকার হাউজ সংশ্লিষ্টরা জানান, যারাই দরবৃদ্ধির সুবিধা নিতে এ শেয়ার বিক্রি করছেন, তাদের সব শেয়ার একাধিক চক্র কিনে নিচ্ছে। বাজারে রটানো হয়েছে, এ শেয়ারের দর আরও দ্বিগুণ হবে। এ অবস্থায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অধিক মুনাফার লোভে শেয়ার বিক্রি কমিয়েছেন। ফলে প্রায় প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য হারে দর বাড়ছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত এক মাসে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি পাওয়া শেয়ারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ওরিয়ন ইনফিউশন। এটি বর্তমানে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে আলোচিত শেয়ার। গত এক মাসে শেয়ারটির দর ১১৭ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৩১০ টাকা ৩০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। যেসব বিনিয়োগকারী আগে শতভাগ মূলধনী মুনাফা নিয়ে শেয়ারটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তারাও এখন আফসোস করছেন। এমন কয়েকজন বিনিয়োগকারী জানান, শেয়ারটির দরবৃদ্ধির ধারা এখনই থামছে না বলে শুনেছেন। কিন্তু কী কারণে দর বাড়ছে এমন কোনো তথ্য কেউ বলতে পারছেন না।

বৃহস্পতিবার দিনের লেনদেন শেষে দেখা গেছে, ইস্টার্ন হাউজিং কোম্পানির শেয়ার সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দর ১০১ টাকা ৪০ পয়সায় কেনাবেচা হয়েছে। মাত্র এক মাসে ৫৭ টাকা ৮০ পয়সা থেকে গতকাল শেয়ারটি দাঁড়িয়েছে ১০১ টাকা ৪০ পয়সায়। এক মাসে ৭৫ শতাংশ দর বাড়ার পরও শেয়ারটিতে ক্রেতার অভাব নেই, উল্টো আছে বিক্রেতা সংকট।

গত এক মাসে মেট্রো স্পিনিংয়ের শেয়ারদর বেড়েছে ৭১ শতাংশ। এ সময়ে বস্ত্র খাতের এ কোম্পানিটির শেয়ারদর ২৬ থেকে গতকাল ৪৫ টাকা ৬০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে স্টক এক্সচেঞ্জের নোটিসের জবাবে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। তারপরও গত কয়েক দিনে সর্বোচ্চ দরে কেনাবেচা হয়েছে কোম্পানির শেয়ারদর।

উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানি আরএসআরএম স্টিলের দরও গত কয়েক দিনে সর্বোচ্চ দরে কেনাবেচা হয়েছে। গত আট কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৪৪ শতাংশ বেড়ে ১৭ থেকে গতকাল ২৪ টাকা ৫০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। কোম্পানিটি শিগগিরই উৎপাদনে ফিরবে, এমন তথ্য বাজারে ছড়ানো হয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকঋণ পরিশোধের পাশাপাশি কোম্পানিটিকে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হবে বলে প্রচার চালানো হয়েছে। যদিও ডিএসইর নোটিসের জবাবে দরবৃদ্ধিতে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় আরএসআরএম কোম্পানির প্রধান উদ্যোক্তা সাম্প্রতিক সময়ে জেলে গিয়েছিলেন। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে উৎপাদনে ফেরার ঘোষণা দেয় কোম্পানিটি। তবে চলতি বছরের এপ্রিলে ডিএসই কর্তৃপক্ষ কোম্পানি পরিদর্শনে গিয়ে উৎপাদন বন্ধ দেখতে পায়।

ইউনিয়ন ক্যাপিটালের শেয়ার দর বেড়েছে ৪ টাকা ২০ পয়সা বা ৫৭.৫৩ শতাংশ। এক মাস আগে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিলো ৮ টাকা ১০ পয়সায়। এক মাসে তা বেড়ে অবস্থান করছে ১১ টাকা ৫০ পয়সায়।

বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘মুলত কোম্পানিগুলো স্বল্প মূলধনি। তাই এসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সহজ। কারসাজিকারীরা অল্প বিনিয়োগ করেই শেয়ারের দাম ইচ্ছেমতো বাড়াতে পারে। ফলে দরবৃদ্ধির কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, মুলত পুঁজিবাজারে গ্যামলিং চলছে। যেখানে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের দামি কমেছে, সেখানে দুর্বল শেয়ারের দরবৃদ্ধির পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দরবৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখা উচিত।