শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি বিচ হ্যাচারির টানা দরবৃদ্ধির পেছনে কারসাজি চক্ররা জড়িত। নামমাত্র পুঁজি। ছয় বছরে কোনও লভ্যাংশ দেয়নি বিনিয়োগকারীদের। উৎপাদন বন্ধ ৫ বছরের বেশি সময় ধরে। গত এপ্রিলের দুই কার্যদিবসে একটি শেয়ারওলেনদেন হয়নি। শেয়ার কারসাজির দায়ে গুনেছে জরিমানা।

জুনের শেষ দিকে এসে মাত্র তিন লাখ ২৭ হাজার নগদ টাকায় ফের ব্যবসা শরুর ঘোষণা। আর এই তিন মাসেই দর বেড়েছে ১২৪ শতাংশের বেশি। পুঁজিবাজারে খাদ্যখাতে তালিকাভুক্ত বিচ হ্যাচারির এসব তথ্য শঙ্কা জাগানোর মতো।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেও গত সোমবার ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৮৭টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে লোকসানি বিচ হ্যাচারির। কোম্পানিটির এমন অবস্থার মধ্যেও শেয়ার দর বৃদ্ধিতে কারসাজি দেখছেন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা। তারা মনে করছেন, দুর্বল একটি কোম্পানি হিসেবে বিচ হ্যাচারি এই পরিমাণ শেয়ার লেনদেন অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০২ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিচ হ্যাচারির গত নয় মাসে (জুলাই, ২০-মার্চ, ২১) শেয়ার প্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ০.২৫ টাকা। ২০১৭ সালের জুন শেষে শেয়ার প্রতি লোকসান ০.৩৯ টাকা, ২০১৮ সালের আলোচ্য সময়ে লোকসান ০.৩৭ টাকা, ২০১৯ সালে লোকসান ০.৩৬ শতাংশ এবং ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ০.৩৪ টাকা।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোম্পানিটির শেয়ার দর গত ৪ মে শেষে ছিল ১১.৮ টাকা। তবে গত সোমবার (১৬ আগস্ট) শেষে দর দাড়িয়েছে ২৬.৫ টাকা। অর্থাৎ ৩ মাসের ব্যবধানে তাদের শেয়ার দর বেড়েছে ১৪.৭ বা ১২৪.৫৭ শতাংশ। কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৪ সালে ৪৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল বিনিয়োগকারীদের। এরপর ২০১৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনও লভ্যাংশ দেয়নি বিনিয়োগকারীদের।

এদিকে চলতি বছরের ১ ও ৪ এপ্রিলে বিচ হ্যাচারির একটি শেয়ারও লেনদেন হয়নি। হঠাৎ গত সোমবার (১৬ আগস্ট) ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৮৭টি শেয়ার লেনদেন হওয়ায় কারসাজির শঙ্কা দেখা দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের মনে।

মো. হাসানুজ্জামান নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, দীর্ঘদিন এই কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। ২০১৬ সালে বন্ধ হওয়ার আগে অর্থাৎ ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা কোনও লভ্যাংশ দেয়নি। এরপরও এক দিনে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ শেয়ার লেনদেন হওয়া চিন্তায় ভাঁজ ফেলবার মতো। এর আগেও কোম্পানিটির মালিকপক্ষ কারসাজির দায়ে জরিমানা গুনেছে। তাই ফের তারা কারসারি করতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।

গত জুনে বিচ হ্যাচারির লিমিটেডের শেয়ার দর কারসাজির দায়ে ৫ জনকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিচ হ্যাচারির পরিচালক ফাহমিদা ইসলামকে ১২ লক্ষ টাকা; মেঘনা চিংড়ি লিমিটেডকে ২৫ লাখ টাকা; সৈয়দ নূর আহমেদকে পাঁচ লাখ টাকা; সায়েফ উল্লাহকে ১০ লাখ টাকা এবং মফিদুল হককে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে। কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম মারা যাওয়ায় তাকে আর্থিক জরিমানা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

এর আগে ২০১১ সালে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দর অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হয়। এজন্য বিএসইসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। অধিকতর তদন্তের জন্য ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর আরও একটি কমিটি গঠন করে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল কোম্পানিটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদন ও ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার ৫ বছরেরও বেশি সময় পর গত ২৮ জুন কোম্পানিটির পক্ষ থেকে পুনরায় উৎপাদনে ফেরার ঘোষণা এসেছে। মাত্র ৩ লাখ ২৭ হাজার ৪৩৯ নগদ টাকা নিয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিচ হ্যাচারি।

সামান্য নগদ অর্থ নিয়ে কী করে কোম্পানিটি পুনরায় ব্যবসা কার্যক্রম শুরু করলো-এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এর নেপথ্যে শেয়ার কারসাজির উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও সন্দেহ তাদের।

কংক্রিট নির্মিত ছোট ১৫টি চৌবাচ্চায় তেলাপিয়া, কৈ, পাঙ্গাস এবং পাবদা মাছ চাষ করার মাধ্যমে এই উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। বছরে মাত্র ১০৫ টন মাছ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কথা জানিয়েছে কোম্পানিটি। কিন্তু এত অল্প পরিমাণ চাষের কৈ, পাবদা ও পাঙ্গাস মাছ বিক্রি করে কোম্পানিটি কত টাকা মুনাফা করবে, আর পরিচালন খরচ শেষে নিট মুনাফা থাকবে কি-না বা বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারবে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গত ৩১ মার্চ তৃতীয় প্রান্তিক শেষে বিচ হ্যাচারির অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটির নগদ ও ব্যাংকে জমা মিলে মোট টাকা ছিল ৩ লাখ ২৭ হাজার ৪৩৯ টাকা। বেশ কিছুদিন ধরে শেয়ার দর অস্বাভাবিক বাড়ছে। এর কারণ জানতে সম্প্রতি ডিএসই থেকে কোম্পানিটিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের জবাবে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কোনো রকম অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দর বাড়ছে।

কেন শেয়ার দর অস্বাভাবিক বাড়ছে জানতে চাইলে বিচ হ্যাচারির কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ নূর ইসলাম কোন মন্তব্য করেননি। শুধু কোম্পানটিরি উৎপাদন র্কাযক্রমে ফরোর তথ্যটি নিশ্চিত করনে।

এদিকে ডিএসইর ওয়েব সাইটে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শেয়ার প্রতি নীটি সম্পদ মূল্য (এনএভি), বছর শেষে শেয়ার প্রতি আয় বা লোকসান (ইপিএস), ঋণের তথ্য ইত্যাদি দেখানো হয়েছে। তবে কোম্পানিটির ওয়েব সাইটে ২০১৯-২০ অর্থবছরের একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

সেটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে উৎপাদন বা ব্যবসা বন্ধ থাকলেও কোম্পানিটি মনগড়া একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছে। সেখানে সব সূচক ঋণাত্মক; তবে বন্ধের প্রতি বছর ধারবাহিকভাবে লোকসান, ইপিএস, এনএভি ইত্যাদি কম দেখানো হয়েছে।

২০১৮ সালের জুন শেষে তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, কোম্পানিটির স্বল্প মেয়াদী ঋণ ছিল ৩ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এবং দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ ১ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এদিকে, কোম্পানিটির রিজার্ভ দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা।

ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা, পরিশোধিত মূলধন ৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা রয়েছে চার কোটি ১৪ লাখ এক হাজার ২১টি। ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষে কোম্পানিটিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা রয়েছে ৪৭.৩৮ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশিদার রয়েছে ১৭.৬৫ শতাংশ। কোম্পানিটির স্পন্সর ডিরেক্টরদের মালিকানা রয়েছে ৩৪.৯৭ শতাংশ।

বিচ হ্যাচারির আর্থিক প্রতিবেদনে ২০১৬ সালে লোকসান দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার টাকা, ২০১৮ সালে ১ কোটি ৫২ লাখ ৯০ হাজার, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৫০ লাখ ২১ হাজার ৫৮ টাকা এবং ২০২০ সালে কোম্পানিটির লোকসান দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ ১৬ হাজার ৩৯৪ টাকা। কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ মূল্য দেখানো হয়েছে, ২০১৬ সালে ১১.২৬ টাকা, ২০১৭ সালে ১০.৮৭ টাকা এবং ২০১৮ সালে ১০.৫০ টাকা।