শাহ এম নাসির উদ্দিন: শিল্প কারখানা দেশান্তরিত করনের গন্তব্যস্থল হতে পারে বাংলাদেশ। করোনা মহামারি পরিস্থিতির পরে, বিশ্ব রাজনীতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে ফলস্বরূপ বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার সব ছেয়ে বড় শিল্প কেন্দ্রে পরিনত হওয়ার সম্ভাবনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার সুহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আপনার কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি তাই আমার প্রাণের দেশের ভবিষ্যত ভাবনায় এই আবেদন।

প্রিয় নেত্রী আপনি অনেক বিচক্ষন, মেধাবী ও সাহসী নেত্রী ও সফল রাষ্ট্র নায়ক। তাই আমার দেশের জন্য ভালবাসার তাগিদে আমার ভাবনা গুলো আপনার দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা। পৃথিবীতে যুগে যুগে মহামারি বহু এসেছে তবে এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। করোনার এই ভয়াবহ তাণ্ডব একদিন শেষ হবেই ।

বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই এখন একটি যুদ্ধ মোকাবেলা করছে। এই যুদ্ধ প্রকৃতির চাপিয়ে দেয়া না কি মনুষ্যসৃষ্ট তা নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক চলছে। বাস্তবতা হলো ভাইরাস গোত্রের এক শত্রু এসে মানবদেহে বসতি গেড়ে কুরে কুরে ধ্বংস করছে তা থেকে বাঁচার উপায় কোন সমরাস্ত্র দিয়ে নয়, মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারবে এই যুদ্ধে তাকে জয়ী করতে এই কথা বিশ্বজুড়ে এখন প্রমাণিত। ’৭১-এর মার্চের মতই বাংলাদেশ এই যুদ্ধ শুরু করেছে গত মার্চেই, সেবারের যুদ্ধে আমাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর এবারের যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই যুদ্ধে দেশের মানুষকে শামিল হতে আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুগে যুগে জাতীয় জীবনে নানা সঙ্কটময় মুহূর্ত আসে। জনগণের সম্মিলিত শক্তির বলেই সেসব দুর্যোগ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেয়েছে। ইতোপূর্বে প্লেগ, গুটি বসন্ত, কলেরার মতো মহামারী মানুষ প্রতিরোধ করেছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সকলের প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হব, ইনশাল্লাহ।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ভয়াবহ তাণ্ডব মোকাবিলা করে পরিমার্জিত পৃথিবীতে ফের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। করোনা পরবর্তীকালে অনিশ্চিত অনিবার্য বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কালে অর্থনৈতিক কূটনীতি বাবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা কিভাবে টিকে থাকতে পারি বা আমাদের করনিয় প্রসংগে: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে৷ অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানি ৷

ইউরোপ, আমেরিকা এই পণ্যটির প্রধান বাজার ৷ করোনা ভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে ইতিমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৮০ ভাগ আসে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট থেকে৷ যেহেতু ইউরোপ ও আমেরিকা আমাদের প্রধান বাজার ও সেই বাজারের আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো চায়না ও চায়নার মিত্র দেশ ভিয়েতনাম, মায়ানমার ও কম্বোডিয়া।

পরিবর্তিত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতৃত্বে তাদের মিত্রদের নিয়ে বিশ্বে একটা চীন বিরোধী বড় জোট গঠন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে । সেক্ষেত্রে এই জোট চীনের বিরুদ্ধে অবরোধ এমন কি চীন ও তার মিত্র দেশ গুলো থেকে সমস্ত বিনিয়োগ তুলে নিতে পারে আর সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ গুলো লাভবান হতে পারে।

এই ক্ষেত্রে আমরা যত দ্রুত পদক্ষেপ ও কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে পারব এবং ঐ সমস্ত দেশগুলোর সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ব্যবসায়িক কূটনীতির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে পারি তাহলে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারবো এবং পাশাপাশি এই সব দেশগুলিতে আমাদের পন্য রপ্তানি অনেক বেশি বেড়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সাহসী ও কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে।

তবে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের অন্তরায় গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো এক জায়গাতেই সমাধান দিতে হবে। ব্যবসা বা শিলপ কারখানা প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রায় ২৭ টা অনুমোদন নিতে হয়, সেগুলো কে সহজেই করনিয় করে এক জায়গাতেই অনুমোদন, ফি প্রদান, পূন:অনুমোদন সহ বাৎসরিক যাবতীয় ফি প্রদানের ব্যবস্থা এক জায়গাতেই করতে হবে, ব্যবসা শুরুর লগ্নে বিভিন্ন রকমের ফি গুলো যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে।

বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানিক সুশাসনের নিশ্চিত করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানী বিনিয়োগকারীদের সমন্বয়ে প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা করে সমস্যা গুলো কে চিন্হিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের সম্মুখীন হওয়া বাধাগুলি কে সুবিধার্থে রূপান্তরিত করে বিদেশী বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগে আরেকটা বড বাধা হল দক্ষ জন গুষ্টির অভাব। সেখানে আমাদের অবশ্যই মানসম্পন্ন জনবলের বিষয়টি এমন একটি বিষয় যা স্বল্প-মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাধান করা দরকার। সর্বোপরি মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে সেখানে আমাদের মালয়েশিয়ার উদাহরণ কাজে লাগাতে পারি। প্রয়োজনে দক্ষ জনশক্তির জন্য বিদেশী কোম্পানীর ও বিনিয়োগ কারীদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

জাপান সরকারের ঘোষিত শিল্প কারখানা দেশান্তরিত করন প্রসংগে: জাপান ইতিমধ্যেই চীন ছেড়ে যাওয়ার জন্য তাদের দেশের বিনিয়োগ সংস্থাগুলিকে অর্থ প্রদান করবে, করোনাভাইরাস উদ্দীপকের অংশ হিসাবে শিল্প কারখানা দেশান্তরিত করনে অন্য কোথা উ্যপাদন ও কারখানা স্থানান্তর করবে। এই জন্য জাপান রেকর্ড অর্থনৈতিক উদ্দীপনা প্যাকেজের আওতায় ২ (দুই) বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি জাপানী মালিকানাধীন কোম্পানি গুলোকে প্রদান করবে যাহা চীন থেকে উত্পাদন কেন্দ্র সরিয়ে নিতে সহায়তা করতে ব্যবহৃত হবে। অন্যদিকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সহ তাদের মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও ধীরে ধীরে চীন ও তার মিত্র দেশ গুলো থেকে কলকারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিবে মনে হয়।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য বিশাল সূযোগ সৃষ্টি হতে পারে যদি বাংলাদেশ এই সূযোগের সময় উপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পথ ধরে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরে ও হংকং এর ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও কলকারখানা চীন থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিশাল সম্ভাবনা থাকবে। এই মূহুর্তে বাংলাদেশ এই সব সূয্যেগ কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।

এই সূযোগ কাজে লাগাতে প্রয়োজনে বাংলাদেশ বেসরকারি বিনিয়োগ অফিস খূলতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষন ও বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রনোদনা ঘোষনা করা যাইতে পারে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কে বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ আনার জন্য কাজে লাগাতে পারে। অন্যদিকে কিছু প্রবাসী ফেরত অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকজন এই দুদেশের সরকার ও অনেক শিল্প কারখানার মালিকদের সাথে সুসম্পর্ক রাখে তাদের কে কাজে লাগাতে পারে।

শুধুমাত্র আমলা নির্ভর বিদেশ কূটনীতির উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি কর্মফলের ভিত্তিতে প্রয়োজন বেসরকারি নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে যারা সরকারের হয়ে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসার যোগ্যতা রাখে। সর্বোপরি বিনিয়োগ আকর্ষনে আমরা নিয়মিত সিঙ্গেল কান্ট্রি বিনিয়োগ রোডসো আয়োজন করতে পারি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে চাইনিজ বিনিয়োগের বিশাল দ্বার খুলে যাবে মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন আশঙ্কা প্রকাশ করছে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব মহামারি পরিবর্তিত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতৃত্বে তাদের মিত্রদের নিয়ে বিশ্বে যদি চীন বিরোধী বড জোট গঠন হয়ে যায় সেক্ষেত্রে এই জোট চীনের বিরুদ্ধে অবরোধ এমন কি চীন ও তার মিত্র দেশ গুলোর রপ্তানি বানিজ্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা কে সামনে রেখে, চীন তার বর্তমান ব্যবসা বানিজ্য কে ধরে রাখতে নিজ দেশের অনেক শিল্প কারখানা ও বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ চীনের বিশ্বস্ত বানিজ্য অংশীদার, তাই এই মূহুর্তে ও নিকট ভবিষ্যতে এই দেশ হতে পারে চাইনিজ বিনিয়োগের নিরাপদ স্থান।

বাংলাদেশ এই মূহুর্তে চীনের কাছে বিশেষ সমর্থন ও মর্যাদা প্রাপ্ত দেশ। বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সম্পর্কে চীন যথেষ্ট সন্তুষ্ট। বাংলাদেশে এখন প্রায় ১০০ (একশ) টির বেশি চীনা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশে এই মূহুর্তে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনও সমস্যা নেই। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ লক্ষ রেখে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব পরবর্তীকালে বাংলাদেশ চীনা বিনিয়োগেরগুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হতে পারে। আকর্ষণীয় বিনিয়োগের গন্তব্য হওয়ায় আরও চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসবে।

এই মূহুর্তে বাংলাদেশ কে বন্ধুত্ব কূটনীতিতে চীন “বাংলাদেশ-চীন” সম্পর্ককে ভালো বন্ধু, ভাল প্রতিবেশী এবং বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসাবে বিবেচিত। চীন আমাদের অনেক মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান বিনিয়োগকারী ও অংশীদার। চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সাথে অর্ধসমাপ্ত মেগা প্রোজেক্ট গুলি দ্রুত সমাপ্তির মাধ্যমে মুল অর্থনৈতিক স্রোতোধারায় নিয়ে আসাটা অত্যন্ত জরুরী। যদি সঠিক সময় সঠিকভাবে কৌশল প্রয়োগ করতে পারে তবে কমপক্ষে ৪/৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি চাইনিজ বিনিয়োগ আশা করা যায়, যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কয়েক লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে।
চলবে……

শাহ এম নাসির উদ্দিন, এস ভি পি
ঢাকা ইউনিভার্সিটি এম বি এ এসোসিয়েশন