শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: চলতি সপ্তাহে আসছে নতুন মুদ্রানীতি। বিনিয়োগবান্ধব ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি ঘোষণার দাবি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির অর্থবছরের প্রথমার্ধের ২০১৮-১৯ (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন। এদিকে নতুন মুদ্রানীতি পুঁজিবাজারবান্ধব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। আর বাজার বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, মুদ্রানীতি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে মুদ্রানীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করলেও বাস্তবে পুঁজিবাজারে এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। কারণ বাজারে মুদ্রার সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বেড়ে যায়। অন্যদিকে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কম হলে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট দেখা দেয়। মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

সাধারণত প্রতি বছরই মুদ্রানীতির ঠিক আগে আগে স্নায়ুর চাপে পড়ে পুঁজিবাজার। অনেক বিনিয়োগকারী কিছু সময়ের জন্য সাইডলাইনে চলে যান। তারা ঘোষিত মুদ্রানীতি পর্যবেক্ষণ করে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। অন্যদিকে কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি বাড়তি ফায়দা নিতে মুদ্রানীতিকে সামনে রেখে নানা গুজব রটিয়ে অনেক সময় বাজারে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করে। পুরো বিষয়গুলোই উঠে এসেছে বাজার বিশ্লেষকদের বক্তব্যে।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারি বিনিয়োগকে চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই তা বাড়ছে কচ্ছপ গতিতে। এতে সমাপ্ত অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ তলানিতে নেমে গেছে। গত জুন পর্যন্ত বার্ষিক ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশের মতো, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম। এটি চলতি মুদ্রানীতির ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম।

বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা না থাকায় নতুন মুদ্রানীতি আরো সংকোচনমুখী করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহের এটি ঘোষণা করা হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কাঙ্খিত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাজারে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা দিতে প্রতি ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পাশাপাশি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এর পরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য সংঘাতজনিত অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক সংকুচিত অর্থব্যবস্থা, বিলম্বিত ব্রেক্সিট পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় অর্থবাজারে ক্রমবর্ধমান শ্রেণীকৃত ঋণের হার এবং কিছুটা সংকুচিত উদ্বৃত্ত তারল্য পরিস্থিতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই ঊর্ধ্বগতির ধারাকে ব্যাহত করতে পারে। এমন বাস্তবতা মাথায় রেখেই নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সূত্র জানিয়েছে, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ চলতি মুদ্রানীতির চেয়ে বেশ খানিকটা কমিয়ে ধরা হচ্ছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে আরো সংকোচনমুখী হচ্ছে নতুন মুদ্রানীতি। যদিও তা চলতি মুদ্রানীতির প্রকৃত অর্জনের চেয়ে কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা প্রকৃত অর্জন থেকে কিছুটা বাড়িয়ে ধরা হবে। তবে চলতি মুদ্রানীতি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে তুলনা করলে তা অনেকটাই কমবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, গুণগতমানের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থেই বেসরকারি ঋণে গতি আনার বিকল্প নেই। এ জন্য বেসরকারি ঋণ কেন বাড়ছে না তার কারণ অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, মুদ্রানীতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কারণ মুদ্রানীতি থাকে এক জায়গায়, আর অর্থনীতির বাস্তব চিত্র থাকে আরেক জায়গায়। এর মানে মূল সমস্যা হলো বাস্তবক্ষেত্রে, সেটাকে মুদ্রানীতির মাধ্যমে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

বাস্তব সমস্যাগুলো কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণেই মানুষ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না বলেই আমার ধারণা। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে নান রকম সমস্যা রয়েছে, যেগুলো মুদ্রানীতির বাইরে থেকেই সমাধান করতে হবে। তাঁর মতে, রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকার পরও বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কেন বাড়ছে না, এটা কি ব্যাংকে তারল্য সংকটের জন্য হয়েছে, নাকি ঋণের চাহিদা নেই সেটা অনুসন্ধান করা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, এখানে দেখতে হবে বেসরকারি খাত ঋণ চেয়েছে কিন্তু ব্যাংক থেকে পেয়েছে কি, পায়নি। আমার জানামতে ঋণ চেয়ে পায়নি এমন উদাহরণ নেই। বরং বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাই নেই। এর অর্থ যেকোনো কারণেই হোক উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগটা মোটামুটি সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

তাই বেসরকারি খাতে কেন উৎসাহী হয়ে বিনিয়োগ বাড়ছে না সেটা অনুসন্ধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা কি বিনিময় হারের কারণে হয়েছে, না সুদ বেশি সে জন্য হচ্ছে, নাকি বেসরকারি খাতের লোকেরা ব্যাংকেরও মালিক, সে জন্য ব্যাংক থেকে বেশি প্রফিট পাচ্ছে এ কারণে হয়েছে। এসব বিষয় অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট মোঃ রকিবুর রহমান পুঁজিবাজারবান্ধব মুদ্রানীতি প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, চলতি মুদ্রানীতিতে যেন মুদ্রাবাজারের পাশাপাশি পুঁজিবাজারকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। মুদ্রানীতিতে যাতে এমন কোনো উপাদান না থাকে যা পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির স্বার্থে এটি ধরে রাখতে হব। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ভুলে অথবা মুদ্রানীতির কারণে এই আস্থায় চিঁড় ধরলে তা হবে দুঃখজনক ও আত্মঘাতী। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে যথেষ্ট সতর্ক ও যত্নবান থাকতে হবে।

মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে। ফলে ঋণের সুদের হার কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগে যে মন্দা যাচ্ছে, তা কাটাতেই এবারের মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণ করা হবে।

সুত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণের আধিক্য, তারল্য সংকট এবং ঋণ ও আমানতের অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের চাপে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে ধীরে চলো নীতিতে রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংকই শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বন্ধ করেছে। অন্যদিকে উচ্চ সুদসহ আরো কিছু কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারাও ব্যাংকঋণের চাহিদা করছেন কম। এ জন্য গত জুন পর্যন্ত বার্ষিক ঋণপ্রবৃদ্ধি গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে নেমে গেছে।