emerald-lagoশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বন্ধকী জমি নিলামে উঠায় এ কোম্পানির ভবিষ্যত নিয়ে বিনিয়োগকারীরা দু:চিন্তায় পড়েছেন। ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে না পারায় এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এর গ্যারান্টার পরিচালকদের সম্পত্তি নিলামে তুলছে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড।

সুদসহ ৮৭ কোটি ১১ লাখ টাকা খেলাপির বিপরীতে কোম্পানিটির কারখানা ও স্থাপনাসহ ৭৩২ ডেসিমাল জমি নিলামে বিক্রি করবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির দিলকুশা শাখা। এজন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আগামী এক মাসের (৫ ফেব্রুয়ারি) মধ্যে দরপত্রও আহ্বান করেছে ব্যাংকটি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সজন কুমার বশাক শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকমকে বলেন, আইন অনুযায়ী বেসিক ব্যাংক নিলামের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত যে সময় আছে, তার মধ্যেই আমরা ঋণটি রিশিডিউল (পুণ:তফসিল) করে ফেলবো। বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের এক মামলায় গত বছরের ২৮ মার্চ এমারেল্ড অয়েল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হাছিবুল গণি গালিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এ বিষয়ে এমারেল্ড অয়েলের কোম্পানি সচিব মেহেরুন্নেসা রোজি বলেন, বেসিক ব্যাংকের নিলাম বিজ্ঞপ্তিটি আমরা দেখেছি। তারা আমাদের কাছে অনেকদিন ধরেই ঋণ বাবদ অনেক টাকা পাবে। তবে নিলাম স্থগিতের জন্য উচ্চ আদালতে যাওয়া হবে কিনা এ বিষয়ে আমরা এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেইনি। আর পরিচালনা পর্ষদের সভায় করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ বার্ষিক সাধারণ সভায়(এজিএম) কোম্পানিটির পরিচালক সজন কুমার বসাক আস্থার সাথে শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, দুদকের মামলার কারণে ২০১৫-২০১৬ হিসাব বছরটি আমাদের সঙ্কটে গেছে।

এছাড়া বেসিক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মাইডাস ফাইন্যান্সিং-সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে ঋণ নিয়ে আমাদের সমস্যা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সমস্যার কারণে বছরের প্রায় ছয় মাস আমাদের উৎপাদন বন্ধ ছিল। তবে এসব সঙ্কট কাটানোর জন্য আমরা তৈরি হচ্ছি। তারই জেরে আমাদের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হবে।

বেসিক ব্যাংকের দরপত্রে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরোপিত ও অনারোপিত সুদসহ শাখার ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে চলতি ও মেয়াদি ঋণ হিসেবে ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। সুদসহ সে ঋণ আদায়ে কোম্পানির ৭৩২ ডেসিমাল বন্ধকি জমি ও সেখানে থাকা সব স্থাপনা নিলামে বিক্রি হবে।

এর মধ্যে শেরপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে মোট ৫০৮ ডেসিমাল ও জামালপুরের দুটি স্থানে ২২৪ ডেসিমাল জমি রয়েছে। এসব সম্পত্তি এমারাল্ড অয়েল এবং সংশ্লিষ্ট গ্যারান্টার ও বন্ধকদাতা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল হক গনি, চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম, পরিচালক এএসএম মনিরুল ইসলাম, পরিচালক সজন কুমার বসাক ও অমিতাভ ভৌমিকের নামে নিবন্ধিত রয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের টাকা আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের আগে বন্ধকি জমি নিলামে তুলতে হয়। নিলাম থেকে পাওয়া অর্থে ঋণ সমন্বয় হলে মামলার প্রয়োজন পড়ে না। আবার পুরো ঋণ সমন্বয় না হলে বাকি ঋণের জন্য মামলা করতে পারে ব্যাংক। পরে মামলার মাধ্যমেই বাকি অর্থ আদায়ের পন্থা বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে বন্ধকি ছাড়াও ঋণগ্রহীতার অন্য জমি নিলামে তোলা যায়।

এ বিষয় জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখার ব্যবস্থাপক একেএম মাসুদুর রহমান  বলেন, ব্যাংকের ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি নিলাম দরপত্র আহ্বান করতে হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, কোম্পানি ও এর উদ্যোক্তা পরিচালকদের যে পরিমাণ সম্পত্তি আমাদের কাছে বন্ধক রয়েছে, তার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি দরপত্র জমা দেয়ার সর্বশেষ দিনে তা খোলা হবে। এতে সর্বোচ্চ দরদাতাকে এ সম্পত্তি ক্রয়ের আহ্বান জানানো হবে।

প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গত বছরের ২৮ মার্চ কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এমারাল্ড অয়েলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে তিনি জামিন নিয়ে চিকিত্সার জন্য মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।

দুদকের মামলায় এমারাল্ড গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোট ২০৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে এমারাল্ড অয়েলের বিরুদ্ধে মোট ৭৪ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ করা হয়। মামলায় এমারাল্ড অয়েলে চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম, এমডি হাসিবুল গনি গালিব, পরিচালক এএসএম মনিরুল ইসলাম, সজন কুমার বসাক, অমিতাভ ভৌমিকসহ বেসিক ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়।

মামলার এজাহার অনুসারে, এমারাল্ড অয়েলের চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম, এমডি সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিবসহ এর পরিচালনা পর্ষদ নতুন কোম্পানি চালুর কথা জানিয়ে প্রস্তাবিত ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্পের বিপরীতে ৭৪ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকার ঋণ নেন।

যদিও কোম্পানির চেয়ারম্যান, এমডি ও পরিচালকদের সমন্বিত সম্পত্তি ৩১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেশি দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তদন্ত শেষে ২০১৫ সালে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করে দুদক। আর এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগেই তা আদায় করতে কোম্পানি ও তার উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তুলছে বেসিক ব্যাংক।ৎ

এদিকে বেসিক ব্যাংকের ৮৭ কোটি টাকাসহ অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এমারাল্ড অয়েলের বর্তমান দেনা ১১৭ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের বাইরে মূল পাওনাদার ব্যাংক এশিয়া ও মাইডাস ফিন্যান্সিং লিমিটেড। অবশ্য এ দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিষয়টি এরই মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা।

এমারাল্ড অয়েলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুল হক তুষার বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই এমারাল্ড অয়েলের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছিল না। মামলায় জামিন নিয়ে কোম্পানির এমডি চিকিত্সার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এর মধ্যেও কোম্পানির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ব্যাংক এশিয়া ও মাইডাস ফিন্যান্সের ঋণ সেটেল করা হয়েছে।

বেসিক ব্যাংকের ঋণের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে ব্যাংকটির সঙ্গে কোম্পানির আলোচনা চলছে। সম্পত্তি বিক্রির জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিলামের দরপত্র আহ্বান করা হলেও শেষ পর্যন্ত এর একটি সুষ্ঠু সমাধান আশা করছেন তিনি।

কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ও অন্যান্য সংকটে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি আবারো উত্পাদন কার্যক্রম শুরু করেছে এমারাল্ড অয়েল। তবে মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে বেশ অসুবিধায় রয়েছে তারা। এমতাবস্থায় সম্প্রতি হয়ে যাওয়া বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) এর জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দেন কর্মকর্তারা।

৩০ জুন সমাপ্ত ২০১৬ হিসাব বছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয় এমারাল্ড অয়েল। গেল হিসাব বছরে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখিয়েছে ৩ টাকা ৩৩ পয়সা, আগের বছর বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর যা ছিল ২ টাকা ৮২ পয়সা।

এদিকে চলতি হিসাব বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৩ পয়সা ইপিএস দেখিয়েছে এমারাল্ড অয়েল, আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ১ টাকা ১২ পয়সা। ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়ায় ১৭ টাকা ২৬ পয়সা।

২০১৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এমারাল্ড অয়েল। ১০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে বর্তমানে এর পরিশোধিত মূলধন ৫৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৬ দশমিক শূন্য ৪ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৫৩ দশমিক ৬১ শতাংশ শেয়ার।