বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে তালিকাচ্যুত ৪০ কোম্পানি  গত দেড় যুগে বিনিয়োগকারীদের কাছ খেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় দুই’শত কোটি টাকা। নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগে পুঁজিবাজার থেকে এসব কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। নানা অনিয়মের বেড়াজালে ছিল এসব কোম্পানি। এসব কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নানা ছলনায় হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় দুই’শত কোটি টাকা। কেবল পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুতির কারণে এ অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হলেন বিনিয়োগকারীরা। তাই দুর্বল আইন থাকার কারনে বারবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

বিনিয়োগকারীদের রক্ষার করা জন্য যেন নিয়ন্ত্রকদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। পাশাপাশি আইপিও অনুমোদন পাওয়া কোম্পানির অনিয়ম ও জালিয়াতি অভিযোগ গণমাধ্যমে বের হলেও কর্ণপাত করেন না নিয়ন্ত্রকরা। এসব অভিযোগের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখে না দেখার ভান করেন তারা। আর নিরবে নাকে তৈল দিয়ে ঘুমায়। তাইতো দেড় যুগে হাতিয়ে নিতে পেরেছে দুই’শ কোটি টাকা। কিন্তু নিয়ন্ত্রকরা আইপিও অর্থ সংগ্রহ করার এ নিয়ম সংশোধন করা না হলে বিনিয়োগকারীরা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রসপেক্টস যাচাইবাছাই করার নিয়ম করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুততে কারনে প্রায় দুই’শত কোটি লোকসান গুনতে হয়েছে বিনিয়োগকারীকে।

এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুতির আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার কঠোর ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। তবে তার চেয়েও বড় বিষয় বর্তমানে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটের কোম্পানিগুলো নিয়ে। কারণ, এখানে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির কার্যক্রম তালিকাচ্যুত কোম্পানিগুলোর মতোই । তাই এসব কোম্পানি নিয়েও দুঃচিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা জানান বিশ্লেষকরা। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভুমিকায় থাকায় বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের এক অনুসন্ধানে এরকম মনোভাবের কথা বলেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।

তারা বলেন, আমাদের দেশের পুঁজিবাজার আজব নিয়মে চলছে। নিয়ন্ত্রকদের যা নিয়ম করা উচিত ছিল, তার ধারে কাছে নেই তারা। এ সুযোগে খুব সহজেই নিয়ম ভেঙ্গে নতুন নিয়ম করছে কোম্পানিগুলো। কোন কোম্পানি যদি চায় আইপিওর মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিবে। তার জন্য যা নিয়ম রয়েছে, তার সবই শেয়ারবাজারে নিয়ন্ত্রকদের আইনে পাবেন। প্রথম নিয়ম আইপিও অনুমোদনে কোম্পানি প্রসপেক্টস যাচাই বাছাই করার কোন নিয়ম নেই। অডিট ও ইস্যু ম্যানেজার প্রসপেক্টস যা সাজিয়ে দেয় তাই অনুমোদন করা হয়। তার মানে অডিট ও ইস্যু ম্যানেজার ভুল দিয়ে সাজায় সেটিই অনুমোদিত হচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জে (বিএসইসি)।

ফলে দিনদিন অনিয়ম বেড়েই চলছে। তার প্রতিরোধ করার কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রকরা বরাবরই এই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজারে এই ধরনেই নিয়ম নেই বললেই চলে। আমাদের শেয়ারবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তির করার সরাসরি অনুমোদন দেয় বিএসইসি। কিন্তু আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ অন্যান্য দেশে স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানির অনাপত্তিপত্র বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দেয়ার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, অন্য খাত থেকে টাকা সংগ্রহের চেয়ে পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করা সহজ। এছাড়াও কর অবকাশ এবং সহজেই মেলে ব্যাংক ঋণ। এসব সুবিধার কথা বিবেচনা করে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় অনেক কোম্পানি। পাশাপাশি বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তির করার সরাসরি অনুমোদন দেয় বিএসইসি। কিন্তু আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায়সহ অন্যান্য দেশে স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানির অনাপত্তিপত্র বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দেয়ার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে।

এ প্রসঙ্গে বিএসইসি একাধিক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সংযোজন প্রয়োজন রয়েছে। কারন বিএসইসি’র আইপিও আইন দুবলতার কারনে কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পরে সহজেই শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা। অন্যান্য দেশে স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানির অনাপত্তিপত্র বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দেয়ার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়। কিন্তু আমাদেও দেশে বিএসইসি একাই করেন।

পাশাপাশি বিএসইসিতে আইপিও আইনে কোন নিয়ম নেই প্রসপেক্টস যাচাই বাছাই করার। হতে পারে এটি বিএসইসি আইনের দুর্বলতা। কিন্তু এতে বিএসইসি দায়ী নয়। প্রকৃত পক্ষে এসব অসৎ উদ্দেশে যদি কারো দায়ী করা যায় তা হলো ইস্যু ম্যানেজার। তারপর অডিট। কোম্পানি তো হাতিয়ে নিতে চাবে। তাদের হাতিয়ে নিতে সহযোগিতা করছে ইস্যু ম্যানেজার ও অডিট ফার্ম। বিএসইসি এসব অনিয়ম প্রতিরোধে সজাগ রয়েছে। কিন্তু বিএসইসি আইনের কাছে বাধা। এ বাধা পুরোপুরি দুর করতে বিএসইসির আইপিও আইন সংযোজন করা প্রয়োজন।
অবশ্য আইপিও আইন বিষয়ে বিএসইসি’র নিবার্হী পরিচালক সাইফুর রহামান বলেন, বিএসইসি’র আইপিও আইনে কোন নিয়ম নেই প্রসপেক্টস যাচাই বাছাই করার। আমরা শুধু দেখি আইন অনুসারে বিভিন্ন বৈধ পেপার দেখি। পাশাপাশি আইপিওতে আশার সব নিয়ম গুলো ঠিক মত হয়েছে সেটা দেখি। কিন্তু এ পেপারে অনিয়ম হয়েছে কি, তা যাচাই বাছাই করি না। ভুল যাচাইবাছায়ের কোন নিয়ম নেই বিএসইসিতে। তাই কোম্পানির যাচাইবাছায়ের এ কাজ ইস্যু ম্যানেজার করে। আর অডিট। তবে কোম্পানির অনিয় রোধ প্রসপেক্টস যাচাই বাছাই করা বিষয়টি বিএসইসি ভাবছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূত্র মতে, পুঁজিবাজারকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে দুই’শত কোটি টাকার বেশি নিয়ে তালিকাচ্যুত হয়েছে ৪০ কোম্পানি। মূলত: নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না করা, লভ্যাংশ না দেয়া, দীর্ঘদিন কোম্পানির কার্যক্রম, নানা অনিয়ম অভিযোগসহ বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে কোম্পানিগুলোকে তালিকাচ্যুত করা হয়। তালিকাচ্যুত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সিমেন্ট, চান্দ টেক্সটাইল, চান্দ স্পিনিং, প্যানথার স্টিল, আনোয়ার জুট, স্পেশালাইজড জুট, পেপার কনভারটিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ডেলটা জুট, গাউসিয়া জুট, হাওলাদার পিভিসি, অ্যারোমো টি, ফ্রগলেস এক্সপোর্ট,

সোয়ান টেক্সটাইল, প্রগেসিভ প্লাস্টিক, মিলন ট্যানারি, নিউ ঢাকা রিফ্যাক্টরিজ, শামসের জুট, আহাদ জুট, ইসলাম জুট, হাইস্পিড শিপিং, মিউচুয়াল জুট স্পিনারস, করিম পাইপস, এবি বিস্কুট, ঢাকা ভেজিটেবল, রূপন অয়েল, মেঘনা ভেজিটেবল অয়েল, ন্যাশনাল অক্সিজেন, এসটিএম (ওআরডি), জেম নিটিং, জেএইচ কেমিক্যাল, মার্ক বিডি শিপিং, প্যারাগন লেদার, টেক্সপিক ইন্ডাষ্ট্রিজ, ঈগল বক্স অ্যান্ড ক্যাকটন, রাবেয়া ফ্লাওয়ার, ইস্টল্যান্ড ক্যামেলিয়া লিমিটেড ও জিএমজি ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড। এর মধ্যে মার্ক বাংলাদেশ একাই ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। বাকি অর্থ অন্যান্য কোম্পানিগুলো হাতিয়ে নিয়েছে তালিকাচ্যুত হয়।

জানা যায়, এসব কোম্পানির মধ্যে কোনো কোনো কোম্পানি শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে জন্য। তালিকাভুক্তির আগের কয়েক বছর ব্যবসায়িক পারফরমেন্স খুব ভালো দেখানো হয় এসব কোম্পানির পক্ষ থেকে। কারণ, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হলে অবশ্যই কোম্পানিকে লাভে থাকতে হবে। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর প্রথমে ডিভিডেন্ড দিয়েও পরে চলে উল্টো গতিতে থাকে শেয়ারবাজারে। কোন নিয়ম না মেনেই অসৎ টাকার পাহাড় গড়ে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। কিন্তু কোম্পানি লোকসান দেখায় বছরের পর বছর। এক সময়ে কোম্পানি ভরাডুবি করে পুঁজিবাজার তালিকাচ্যুত হয়।

শেয়ারবাজারে প্রচলিত আইনের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে কোম্পানিগুলো তালিকাচ্যুত হয়। লিস্টিং ফি ফাঁকি, নিয়মিত লোকসান, উৎপাদন বন্ধ, কোনো প্রকার ডিভিডেন্ড না দিয়ে নামেমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে যাতে শেয়ারবাজার থেকে তালিকাচ্যুত হওয়া যায় বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত না দিয়েই। বাস্তবে ঘটেও তাই।

লিস্টিং ফি না দেয়া, শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত করা, নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা না করার ইস্যুতে একে একে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে এসব কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হয়। আইনের ফাঁকফোকরে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে সটকে পড়ে।

কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরৎ দেবার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ কিংবা কোম্পানির পক্ষ থেকেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখনও অনেক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সঞ্চিত মূলধন নিয়ে একই পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে বলে শেয়ার বার্তা ২৪ ডটকমের অনুসন্ধানে জানা গেছে।