শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: কাগজকলমে আছে, অথচ বাস্তবে নেই এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল)। প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি এই ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা জমি এর আগেই অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে একই ব্যাংকের আরেক শাখায় বন্ধক ছিল। ঋণের আবেদনের কাগজপত্রেও ছিল বানোয়াট তথ্য।

এই ঋণ পেয়েছে আবাসন খাতের ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর এনবিএলের পরিচালনা পর্ষদের ৪৩১তম সভায় এই ঋণ অনুমোদন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে এই পরিদর্শন শুরু হয়ে এখনো চলছে। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ আবেদনে উল্লেখিত ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই ঋণে অনিয়মের দায় ব্যাংক এড়াতে পারে না।

অবশ্য ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংক নিয়ম মেনেই ঋণ ছাড় করেছে। এত অনিয়ম থাকলে ঋণ ছাড় হতো না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শনকালে যদি কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়, সে ক্ষেত্রে পরেরটা পরে দেখা যাবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর হাজারীবাগ থানার রায়েরবাজার (পশ্চিম ধানমন্ডি) ঠিকানায় ‘দেশ গার্ডেন সিটি’ নামে ১৬ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের বনানী শাখায় ৪৯০ কোটি টাকার হাউস বিল্ডিং (বাণিজ্যিক) ঋণের জন্য আবেদন করে। ১৫৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ জায়গার ওপর ওই ভবন হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) ছাড়াই ওই বছরের ১০ অক্টোবর পরিচালনা পর্ষদের ৪৩১তম সভায় ওই ১৫৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ জায়গা মর্টগেজ করার শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর মেয়াদি (পাঁচ বছর রেয়াতকালসহ) এই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়ন ও অনুমোদনে ঝুঁকি আমলে নেওয়া হয়নি। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিযুক্ত পর্যবেক্ষককে ৩৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেখিয়েছে। ঋণ ছাড় করার কিছুদিনের মধ্যেই টাকা তুলে নেওয়া হয়।

পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেভেলপার কোম্পানি হিসেবে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের রাজউকের নিবন্ধন, প্রস্তাবিত ভবনের অনুমোদিত নকশা ও অনুমোদনপত্র ছিল না। ব্রডওয়ের আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্য সনদও ছিল না। ছিল না পেশাজীবী প্রকৌশলীর অনুমোদিত প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয়, সহায়ক জামানতের ক্ষেত্রে ব্যাংকের আইনগত পরামর্শ, প্রকল্প বাস্তবায়নের শিডিউল ও আর্থিক পরিকল্পনা।

ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. ইসমাঈল এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শরীফুজ্জামান খান। এই ঋণের বিপরীতে যে জমি বন্ধক রাখা হয়, তা আগেই একই ব্যাংকের মহাখালী শাখায় হাসান টেলিকমের অনুকূলে ৩৩৫ কোটি টাকার ওডি (জি) ঋণের জন্য রেজিস্টার্ড বন্ধক করা।

হাসান টেলিকমের চেয়ারম্যান আরিফ হাসান। তিনি ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ব্রডওয়েকে ঋণ দেওয়ার পর থেকে হাসান টেলিকমের ঋণদায় সমন্বয় হতে শুরু করে। এ থেকে প্রমাণিত, এই ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জেনে-বুঝে সহযোগিতা করেছে। এ জন্য ব্যাংক ঋণে অনিয়মের দায় এড়াতে পারে না।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সদস্যদের তালিকা ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। সেখানে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডের নাম নেই। প্রতারণা ঠেকাতে যে কেউ ওয়েবসাইটে সদস্যতালিকা যাচাই করতে পারেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের আবেদনের সঙ্গে দেওয়া কাগজপত্রে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, রায়েরবাজারে গিয়ে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরিদর্শকেরা পরে জানতে পারেন, সেটি মূলত একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ঠিকানা। গত রোববার এই প্রতিবেদকও সরেজমিনে রায়েরবাজারে গিয়ে ব্রডওয়ের কার্যালয় খুঁজে পাননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে ব্যাংকে দেওয়া কাগজপত্রে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা শুরুর তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ওই বছরের ১ জুলাই। এটি অসংগতিপূর্ণ।

এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের বনানী শাখায় ব্রডওয়ের হিসাব খোলা, পরিচালনা এবং ঋণ গ্রহণের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীর তথ্য পাওয়া যায়নি। এসব ব্যাংকিং নিয়মের পরিপন্থী। ব্রডওয়ের ব্যবসা দেখানো হয়েছে ৬৫ দশমিক ৪৫ লাখ টাকা, যা অসংগতিপূর্ণ। কারণ, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৬৪০ কোটি ১৬ লাখ টাকা ধরা হয়। এর মধ্যে ১৫০ কোটি ১৬ লাখ টাকা ইক্যুইটি ও ৪৯০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ দেখানো হয়েছে।

তবে প্রকল্পে ভূমি ও ভূমি উন্নয়ন বাবদ গ্রাহক ১০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা নিজ উৎস থেকে ব্যয় করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ও পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির সপক্ষে কাগজপত্র না থাকায় ভূমি ও ভূমি উন্নয়ন বাবদ এই ব্যয় বানোয়াট।
প্রতিবেদন বলছে, ব্রডওয়ের পরিচালকদের সম্মিলিত ব্যক্তিগত নিট সম্পদ ৩২ কোটি ২২ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মো. ইসমাঈলের ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, এমডি মোহাম্মদ শরীফুজ্জামান খানের ২৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, পরিচালক মো. ফজলে রাব্বির ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও তাওসিফ-সাইফুল্লাহর ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা দেখানো হয়।

তাই ইক্যুইটি হিসেবে ১৫০ কোটি ১৬ লাখ টাকা দেখানো ছিল কল্পনাপ্রসূত ও বানোয়াট। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় প্রস্তাবিত জমি নিজ উৎস থেকে কেনা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১১ সালের ১৮ জুন সিআইবি রিপোর্ট গ্রহণের উল্লেখ করা হলেও কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ছিল ২০১১ সালের ৪ জুলাই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দলিলাদি না থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য স্মারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করলে তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই নিতে হবে। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ঋণ পাওয়াটা সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের হিসাব খোলার ফরমের লেনদেন প্রোফাইল অনুযায়ী একক সর্বোচ্চ উত্তোলন সীমা নগদ ১০ লাখ টাকা ও ট্রান্সফার/ইনস্ট্রুমেন্ট ১০ লাখ টাকা। কিন্তু ওই গ্রাহকের ঋণ হিসাব থেকে ১৫৮ কোটি টাকা গ্রহীতার চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে চলতি হিসাব থেকে পে অর্ডারের মাধ্যমে ২৮ কোটি টাকা এবং বাকি ১৩০ কোটি টাকা ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে নগদ উত্তোলন করা হয়। এতে গ্রাহকের একক উত্তোলন সীমাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এ ছাড়া গ্রাহকের ব্যবসার ধরনের সঙ্গেও বড় অঙ্কের নগদ অর্থ লেনদেন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে পে অর্ডারের ক্লিয়ারিং ইমেজ ও চেকগুলোর ফটোকপি পরিদর্শক দল দিতে বললেও ব্যাংক অপারগতা জানায়। ঋণ কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিছু জানাতে পারেনি। এ ছাড়া ব্যাংকের ট্রেজারি ডিভিশন থেকে ঋণের অর্থ ছাড়করণের বিষয়ে কোনো অনাপত্তি গ্রহণ করা হয়নি, যা নিয়মের লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের অনিয়ম পরিদর্শন একটি রুটিন কাজ। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’সূত্র: আজকের পত্রিকা