শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি বিএসআরএম গ্রুপের দুই কোম্পানির বড় লোকসান নিয়ে ধোয়াশা কাটছে না। কোম্পানিটি সর্বোচ্চ দামে রড বিক্রি করেও কী ভাবে লোকসান। এ প্রশ্ন খোদ বিনিয়োগকারী সহ বাজার সংশ্লিষ্টদের। দেশের বাজারে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের প্রতি টন ইস্পাত বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯২ হাজার টাকায়; যা গত বছরের এ সময়ে ছিল ৭৪ হাজার টাকা।

অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ১৮ হাজার টাকা। অথচ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে বিএসআরএমের ইস্পাত বিক্রয়ে লোকসান করেছে ১৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা।

অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে পাঁচ টাকা ৫১ পয়সা। অথচ গত অর্থবছরের এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৪ টাকা ২৯ পয়সা। একই গ্রুপের মালিকানাধীন বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডও শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৯৩ পয়সা; যা বাজার-সংশ্লিষ্টদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) সূত্র মতে, দেশের পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ইস্পাত খাতের বিএসআরএম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড ও বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড। এর মধ্যে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট বিক্রয় রাজস্ব হয়েছে এক হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা।

আর বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ছিল এক হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। এ সময়ে অন্যান্য ব্যয় পরিশোধ করার পর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে পাঁচ টাকা ৫১ পয়সা। অর্থাৎ লোকসান করেছে ১৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরের এ সময়ে কোম্পানিটির নিট মুনাফা ছিল ১২৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি আয় ছিল চার টাকা ২৯ পয়সা।

অন্যদিকে বিএসআরএম গ্রুপের আরেক সহযোগী ইস্পাত বিক্রয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড। ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট বিক্রয় রাজস্ব হয়েছে এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। একই সময়ে অন্যান্য ব্যয় পরিশোধ করার পর প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছে ৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৮৯ পয়সা।

যেখানে গত অর্থবছরের এ সময়ে কোম্পানিটির মোট বিক্রয় রাজস্ব ছিল এক হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এতে নিট মুনাফা হয়েছিল ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি আয় ছিল দুই টাকা ৮৯ পয়সা। অথচ গত বছরের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় বেড়েছে ৩৬৪ কোটি টাকা।

কোম্পাটির সর্বশেষ বিক্রয় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) ও বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড গত দুই অর্থবছরের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন ও বিক্রি করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিষ্ঠান দুটির মোট বিক্রি ছিল ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫৯২ মেট্রিক টন। নিট মুনাফা করেছিল ৬৩৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রতিষ্ঠান দুটির মোট বিক্রি ছিল ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭১৫ মেট্রিক টন। এতে নিট মুনাফা হয়েছে ৮০১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ বিক্রয় ও নিট মুনাফা বিএসআরএমের ইতিহাসে রেকর্ড।

লোকসানের বিষয়ে বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর বলেন, এলসি পেমেন্টে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালে দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকসান হয়েছে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের প্রান্তিক হিসাবে উপস্থাপন করছি। কিন্তু ওয়েবসাইটে বিস্তারিত প্রতিবেদন আপলোড করা হয়নি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আপলোড করেছি। তবে তিনি কোনো ধরনের সঠিত উত্তর দিতে পারেনি। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরে রড বিক্রয় করা হলে কীভাবে লোকসান হলো সেই বিষয়ে সঠিক বক্তব্য দিতে পারেনি বিএসআরএমের এ কর্মকর্তা।

উল্লেখ, দেশের পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ইস্পাত খাতের বিএসআরএম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড ও বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড। এর মধ্যে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ২৯৮ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা দেয়। অপরদিকে বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড ২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৩৭৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে।

তথ্যমতে, একক কোম্পানি হিসেবে ইস্পাত াতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের স্টিলস রি-রোলিং মিলস। লং স্টিলে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ লাখ টন। এছাড়া বিএসআরএম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক উৎপাদন ১৪ লাখ টন।

আর দেশের অন্যতম বৃহত্তম কবির স্টিল রি-রোলিং (কেএসআরএম) মিলের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা আট লাখ মেট্রিক টন, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস (আরএসআরএম) লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা এক লাখ ৮৭ হাজার টন এবং জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা এক লাখ ২০ হাজার টন।

খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে দেশের ইস্পাতের বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ চাহিদার নেপথ্যে রয়েছে সরকারের উন্নয়নযজ্ঞ। এদিকে বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিক টন হলেও এখন পর্যন্ত চাহিদা প্রায় অর্ধেক। তবে আগামীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, ছোট-বড় সেতু, শিল্প স্থাপনাসহ অনেক প্রকল্পের কাজে গতি আসবে।

এছাড়া মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। এতে মাথাপিছু রডের ব্যবহার ২৬ কেজি থেকে ৫০ কেজিতে উন্নীত হবে। এছাড়া আবাসন খাত চাঙা এবং ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোয় রপ্তানি বাড়লে ২০৩০ সালে ইস্পাতের চাহিদা দাঁড়াবে এক কোটি ৮০ লাখ টনে। এতে ইস্পাতশিল্পের প্রবৃদ্ধি পাঁচ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সুযোগ আছে।

এ বিষয়ে বিএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, বর্তমান সরকারের নেয়া প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। দেশের যত বেশি শিল্পায়ন হবে তত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। তবে বিবেচনা করা উচিত, যে খাতে আমাদের এখনও অনেক ঘাটতি আছে, সেসব খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। আর ইস্পাত খাতে যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তা চিন্তার বিষয়।

কারণ আমাদের এ শিল্প পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হওয়ায় কাঁচামালের আন্তর্জাতিক দর, বিনিময় মূল্যহার, পোর্ট সক্ষমতাসহ নানা বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। এছাড়া ভারতের সেভেন সিস্টারের বাজার পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নেই; কারণ ভারতে আমাদের চেয়েও অনেক কম খরচে উৎপাদন করা হয় এবং ট্রানজিট সুবিধা আছে। সুতরাং এ বিষয়ে আরও ভাবতে হবে।