শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি খাতের পাঁচ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মূলত পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে আট বছর পর সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্তির জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তার সবগুলোই মুনাফায় রয়েছে।

হালনাগাদ আর্থিক প্রতিবেদনও রয়েছে। এখন সম্পদ পুনর্মূল্যায়নসহ কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেই কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারবে। কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা সরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে চারটিই হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জড়িত। এ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি), আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড ও বি-আর পাওয়ারজোন লিমিটেড (বিআরপিএল)। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশই আসে এসব কোম্পানি থেকে। আর তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা অপর কোম্পানি গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল), যে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে জাতীয় গ্যাস সঞ্চালনের প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারি মালিকানাধীন এসব কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফায় রয়েছে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন। আর মুনাফায় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেড। সবগুলো কোম্পানিই বিশ^ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে স্বল্পসুদের ঋণ নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার সবগুলোই লাভজনক।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সাতটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১ হাজার ৮১৩ মেগাওয়াট। এছাড়া বিদেশিদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আরও তিনটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে চুক্তি করেছে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার। পায়রাতে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক ৬ হাজার ২৪০ মেগাওয়াটের তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মিত হবে। এর বাইরে আরও কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়ায় ২০২৫ সালে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ারের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট।

নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে কোম্পানির বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে আয় হয় ৩ হাজার ৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ১ শতাংশ কম। উৎপাদন ব্যয় শেষে মোট মুনাফা হয়েছে ৮০৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা ২০১৭-১৮ হিসাব বছরের তুলনায় ৪৯ শতাংশ বেশি। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ¦ালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় কমেছে। প্রশাসনিক, সুদ ব্যয়, অবচয় ও কর পরিশোধের পর ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে কোম্পানির নিট মুনাফা হয় ৩২৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৭১ শতাংশ বেশি।

২০১৮-১৯ হিসাব বছর শেষে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশনের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ১৬০ কোটি টাকা। এ সময় শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয় ২০ টাকা ৪৫ পয়সা, যা গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ।

শুরুতে তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যাত্রা করে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি), যার উৎপাদন ক্ষমতা ৯৫৪ মেগাওয়াট। এর বাইরে আরও অন্তত আটটি সৌর, বায়ুচালিত ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে। এসব প্রকল্প উৎপাদনে এলে ইজিসিবির উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে ২০২৪ সালের মধ্যে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে আরও কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির। এ কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ৮ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ৩৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ হিসাব বছরে বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে ইজিসিবির আয় হয় ৯৩৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ইজিসিবির নিট মুনাফা হয়েছে ১৮১ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১৭৫ কোটি টাকা।

সরকারি বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি। এ কোম্পানিটির ৮টি ইউনিটের মাধ্যমে ১ হাজার ৬৯০ মেগাওয়াট বিদুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছু নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ায় আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ এ কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৩ হাজার ৬০ মেগাওয়াট। এ কোম্পানি ইতিমধ্যেই পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

২০১৮-১৯ হিসাব বছরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে আশুগঞ্জ পাওয়ারের আয় হয়েছে ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে নিট মুনাফা হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।

বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেড বর্তমানে গাজীপুরের কড্ডায় ১৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পরিচালনা করছে। এছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, যা চলতি বছরই বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে। এছাড়া শ্রীপুরে ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তেলভিত্তিক ও মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের কাজ চলছে।

আগামীতে মিরসরাই ও মহেশখালীতে মোট ১ হাজার ৭২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বি-আর পাওয়ারজেনের পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ২৭৬ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে বি-আর পাওয়ারজেনের আয় হয় ৫৭৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। কর পরিশোধের পর নিট মুনাফা হয় ৭৬ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১২১ কোটি টাকা।

সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে জাতীয় গ্যাস গ্রিড সম্প্রসারণে অন্যতম ভূমিকা রাখে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। বর্তমানে দেশের উৎপাদিত গ্যাসের ৭৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ সঞ্চালন হয় এ কোম্পানির মাধ্যমে। পেট্রোবাংলার অধীনস্ত জিটিসিএলের পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ৭০০ কোটি টাকা। গ্যাস সঞ্চালন চার্জই কোম্পানির আয়ের উৎস। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে জিটিসিএলের করপূর্ববর্তী মুনাফা ছিল ৩২০ কোটি টাকা। আর কর পরিশোধের পর নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৯৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।