শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা: বছরজুড়ে সূচক ও লেনদেনে মন্দাভাব প্রধান পুঁজিবাজারে। সমালোচনার মুখে পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। বছরজুড়ে ধারাবাহিকভাবে লেনদেন ও সূচক কমে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে পুঁজিবাজার। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসময় অতিবাহিত করছে। অতীতের যে কোন সময়ের থেকে খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে বাজার ধ্বসের পর বাজারের যে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমান বাজার তার চেয়েও অনেক খারাপ, অনেক ভয়াবহ।

১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে শেয়ার গুলো ছিল অতি মূল্যায়িত তাই স্বাভাবিক ভাবেই মূল্য সংশোধন হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজার এতো বেশি ভয়ংকর যে অবমূল্যায়িত শেয়ারগুলো দিন দিন আরও বেশি অবমূল্যায়িত হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোম্পানির শেয়ারগুলো এক অদৃশ্য শক্তির বলে তার অভিহিত মূল্যের নিচে চলে যাচ্ছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বর্তমানে ৩৫৬টি কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ২০০টি কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ড এর দাম বর্তমানে ২৫ টাকা বা তার নিচে রয়েছে। আরও ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে ১০০টির উপর কোম্পানি বর্তমানে ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। গত ১ বছরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৪টি কোম্পানি। এই ৪টি কোম্পানিই ১ বছর অতিবাহিত না হতেই তার কাট-অফ প্রাইজের নিচে চলে গেছে।

এই কোম্পানিগুলোতে যারা প্রাইমারি শেয়ার পেয়েছিল তারাও লোকসানে চলে গেছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি উচিত হবে কোম্পানিগুলো নিয়ে অধিকতর তদন্ত করা। কেন কোম্পানি গুলোর দাম ১ বছর না যেতেই ইস্যু মূল্যে থেকে ৩০ শতাংশ নিচে চলে গেল। প্রয়োজনে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোম্পানি গুলোকে দিয়ে শেয়ার বাই-ব্যাক করানো যেতে পারে।

বর্তমান পুঁজিবাজারে যেখানে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম তার ইস্যু মূল্যের নিচে বা কাছাকাছি অবস্থান করছে। সেখানে কিছু দুর্বল মৌলভিত্তিক স্বল্প মূলধনী কোম্পানি তার ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে অবস্থান করছে। যা বর্তমান পুঁজিবাজারকে ভারসাম্যহীন করে দিয়েছে। ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ী ১০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের চিন্তা করলো। সেই ব্যাক্তি যদি দেখে এই বাজারে, মুন্নু সিরামিক, মন্নু জুট স্টাফলার, স্টাইল ক্রাফট, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার,ওয়াটা কেমিকেল, জেমিনি সি ফুড, কে এন্ড কিউ এর মত বন্ধ অথবা দুর্বল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের লেনদেনের প্রথম স্থান গুলো ধরে রেখেছে। তাহলে ঐ ব্যবসায়ী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ তো দূরের কথা, যদি তার বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে কিছু থেকেও থাকে তাও তুলে নেবে।

ভালো ফলনের জন্য ক্ষেতের আগাছা পরিস্কার করতে হয়। ঠিক তেমনি পুঁজিবাজার ভালো করতে বাজারের আগাছা (Z) গুলো পরিস্কার করতে হবে। পাঁচ বছর থেকে ডিভিডেন্ড দেয় না অথবা দীর্ঘদিন থেকে উৎপাদন বন্ধ এমন কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করতে হবে। পাশাপাশি ঐ সকল কোম্পানির ডিরেক্টরদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা নিশ্চিত যে পুঁজিবাজার ভাল করতে হলে ভালো কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বল কোম্পানি দিয়ে বাজার নষ্ট করা যায়, ভালো করা যায় না।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই দুরবস্থার অন্যতম আরও একটি কারণ হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংক গুলোর কর্মকর্তাদের চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্নীতি। তাই ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতি পেলে কঠিন শাস্তি প্রদান করতে হবে। যা দেখার পর অন্যরাও যেন সতর্ক হয়ে যায়। প্রয়োজনে ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের ব্ল্যাক লিস্ট করে দিতে হবে। যাতে ঐ ব্যক্তি ভবিষ্যতে যেন কোন ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আর চাকরি করার সুযোগ না পায়।

পুঁজিবাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি। একটি কথা হয়তো আমারা ভুলে গেছি, রাজার ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায় যদি তা লুটপাট হয়। তাই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সুশাসন ফিরিয়ে না আনলে এই বাজার সহজে ভালো হবে না। সব চেষ্টাই একটার পর একটা ব্যর্থ হবে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কারসাজি ঠেকাতে না পারায় আস্থার সংকটে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে দেশের পুঁজিবাজার। এ অবস্থাকে ১৯৯৬ সাল বা ২০১০ সালের চেয়েও করুণ অবস্থা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের সময় মন্দা দিয়েই শেষ হয় দেশের প্রধান পুঁজিবাজারের লেনদেন। তখন মন্দার কারন হিসেবে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। নির্বাচনের পর বছরের শুরুতে পূজিবাজার নিয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। জুনে বাজেটের পরপর পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে। এ সময় একের পর দর ও সূচক পতনের রেকর্ড ঘটনাও ঘটে ঢাকা পুঁজিবাজারে।

পতনের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম দিনে হওয়া লেনদেন ৬৯৬ কোটি টাকা কমে ২২ ডিসেম্বর দাড়িয়েছে ২৭০ কোটি টাকায়। আস্থার সংকটেই পুঁজিবাজারের এই করুণ দশা, বলছেন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মোশতাক সাদেক। তিনি বলেন, ওই সময়ে আমরা বিনিয়োগকারী হারাইনি, তাদের কিছু টাকা হারিয়েছে। কিন্তু এখন আমরা বিনিয়োগকারী হারিয়েছে। ২০১০ এ যেটা হয়েছে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য হয়েছে, এখন যেটা হয়েছে সেটা নজরদারীর অভাবের কারণেই হয়েছে।

সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পুঁজিবাজারে যেভাবে চুরি-ডাকাতি হচ্ছে তাতে বিনিয়োগকারীরা একবারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ৯৬ সালে যারা হোতা ছিলেন আমাদের রিপোর্টে একই নামগুলো এসেছে। একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী তারা পারলে সরকারকে গ্রাস করে ফেলে। অনেকে বলছে সরকারেরও ক্ষমতা নেই তাদের শাস্তি দেয়ার। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আমুল পরিবর্তন ও বাইব্যাক আইনের বিকল্প নেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।