risk-359x201এইচ কে তারেক : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২০ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের দর কোন কারন ছাড়াই লাগাতর বাড়ছে। যা বাজারের জন্য অশনি সংকেত। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নজরদারীতে দাপট কমছে না ঝুঁকিপুর্ণ শেয়ারগুলোর। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও এক ধরনের আশঙ্কা কাজ করছে।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন বাজার নিয়ে বারবার কারা খেলছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য কি এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীল করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা যার যতটুকু সাধ্য তা নিয়ে চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তারপরও কোথাও যেনো একটি গলদ থেকে যাচ্ছে এবং বাজার উঠতে গেলেই একটি অদৃশ্য শক্তি সূচকের পেছন থেকে নিচের দিকে টেনে ধরে। মূলত এই অদৃশ্য শক্তিটিই বার বার পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে। ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধ্বসে এদের সক্রিয়তা ছিল। এদের কারনে নিংস্ব হয়েছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন এরা কারা? বিএসইসির চেয়ে কি এরা শক্তিশালী?

একাধিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএসইসিতে নাকি অত্যাধুনিক সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বসানো হয়েছে এ সফটওয়্যার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সফটওয়্যারের কাজ কি? সবচেয়ে বড় কথা হলো যা খালি চোখে দেখলেই অস্বাভাবিক মনে হয় তার জন্য সার্ভিল্যান্সেরই কি প্রয়োজন?

এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারগুলো ননমার্জিনেবল, বেশিরভাগের মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) রয়েছে ৪০-এর উপরে। এসব শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। আর ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় এসব শেয়ার কিনতে সিকিউরিটিজ হাউস বা মার্চেন্টব্যাংকগুলো ঋণ সরবরাহ করে না। কিন্তু তারপরও এসব কোম্পানির শেয়ারের দর প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যাকে ‘ব্যাকরণ বর্হিভূত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

তবে বিষয়টি নজর এড়ায়নি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের। ইতোমধ্যে কয়েকটি কোম্পানিকে দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে নোটিস পাঠিয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। জবাবে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তাদের শেয়ারদর বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই।

বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বেশ কিছু শেয়ারের দর লাগামহীন ভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে ঝিলবাংলা সুগার, শ্যামপুর সুগার, ফাইন ফুডস, আরএন স্পিনিং, রহিমা ফুড, মেঘনা পিইটি, ফাস্ট ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, বিডি অটোকারস, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, ইমাম বাটন, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, দেশ গামেন্টন্স, আজিজ পাইপস, মর্ডান ডাইং,

আরডি ফুড, আনোয়ার গ্যালভাইনিজিং, শাশা ডেনিমস, ডেরিন পাওয়ার। এসব কোম্পানির বেশিরভাগই লোকসানি, তাই আগামীতে আশানুরূপ ডিভিডেন্ড ঘোষণা না করার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও এক শ্রেণির কারসাজি চক্রের সদস্য সুযোগ নিচ্ছেন।

প্রাপ্ত তথ্যনুযায়ী, নন-মার্জিনেবল কোম্পানির দর বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির চতুর বিনিয়োগকারী। তারা অল্প টাকা বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। বেশিরভাগই লোকসানি কোম্পানি বা পিই রেশিও মাত্রাতিরিক্ত।

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প করপোরেশনের তিনটি প্রতিষ্ঠান রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, জিলবাংলা ও শ্যামপুর সুগার মিলের শেয়ারদর বেড়েছে গড়ে ৩০০ শতাংশেরও ওপর। কিন্তু সেদিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি-ও নিশ্চুপ রয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, জিলবাংলা সুগারের শেয়ার সর্বশেষ কার্যদিবসে সমাপনী দরছিল ৪১.৯০ টাকা। ওই দিন সর্বশেষ লেনদেন হয় ৪১.৯০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ১৬ টাকা।

শ্যামপুর সুগারের শেয়ার সর্বশেষ কার্যদিবসে সমাপনী দরছিল ২০ টাকা এবং সর্বশেষ লেনদেন হয় ২০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ১০.৯০ টাকা এবং সর্বোচ্চ লেনদেন হয় ২০.৯০ টাকা।

এদিকে আরএন স্পিনিংয়ের শেয়ার গতকাল লেনদেন হয় ২৬.৬০ টাকা। এক মাস আগে এর দর ছিল ১৭.৪০ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে এর প্রতিটি শেয়ারের দর বেড়েছে সাত টাকা ২০ পয়সা।

এক মাসের ব্যবধানে রহিমা ফুডের শেয়ারদর বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। সর্বশেষ কার্যদিবসে সমাপনী দরছিল ১৩৯.৫০ টাকা এবং সর্বশেষ লেনদেন হয় ১৩৮.৬০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ৫১.২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ লেনদেন হয় ১৪৯.৫০ টাকা।

একই সময় বিডি অটো কারসের প্রতিটি শেয়ারদর বেড়েছে ছয় টাকারও বেশি। এ সময়ের মধ্যে অভিহিত দরের নিচে থাকা মেঘনা পিইটির প্রতিটি শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় দুই টাকা।

একইভাবে ফাস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ১.৪০ পয়সা, মাইডাস ফাইন্যান্সের শেয়ার প্রায় এক টাকা এবং সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় দুই টাকা। মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক শেয়ার গত বৃহস্পতিবার সমাপনী দর ছিল ৮.৭০ টাকা। এক মাস আগে এর দর ছিল ৬.৯০ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে এর প্রতিটি শেয়ারের দর বেড়েছে ১.৮০ টাকা। শতকরা হিসেবে যা ২৬.০৮ শতাংশ বেড়েছে।

ইমাম বাটন শেয়ার গত বৃহস্পতিবার সর্বশেষ লেনদেন হয় ১২.৯০ টাকা। ঐদিন যার সমাপনী দরছিল ১২.৮০ টাকা। এদিকে গত এক মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ১১.১০ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে এর প্রতিটি শেয়ারের দর বেড়েছে ১.৮০ টাকা।

রেনউইক যজ্ঞেশ্বর শেয়ার গত বৃহস্পতিবার সর্বশেষ লেনদেন হয় ৬৪৪ টাকা। ঐদিন যার সমাপনী দরছিল ৬৩৫.৭০ টাকা। এদিকে গত এক মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ৫৬৭.১০ টাকা।
দেশ গামেন্টন্স শেয়ার গত বৃহস্পতিবার সমাপনী দরছিল ৩০৮.২০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ২২৩.৭০ টাকা।

আজিজ পাইপস শেয়ার সর্বশেষ কার্যদিবসে সমাপনী দরছিল ৭০.২০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ৫২.১০ টাকা এবং এসময় সর্ব্বোচ দর উঠে ছিল ৭১.৫০ টাকা।
মর্ডান ডাইং শেয়ার সর্বশেষ কার্যদিবসে সমাপনী দরছিল ১৭১.৯০ টাকা। এদিন শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেন হয় ১৭৩ টাকায়। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ১৫৮.৭০ টাকা । আলোচ্য সময়ে শেয়ারটির সর্ব্বোচ দর উঠে ২৪৮.৭০ টাকা।

আরডি ফুড শেয়ার গত বৃহস্পতিবার সমাপনী দরছিল ১৯ টাকা। ঐদিন শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেন হয় ১৯.১০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ১৩.৩০ টাকা।
আনোয়ার গ্যালভাইনিজিং গত বৃহস্পতিবার সমাপনী দরছিল ৭০.৯০ টাকা। ঐদিন শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেন হয় ৭১ টাকা। এদিকে তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ৬৬.৮০ টাকা। এসময় সর্বোচ্চ দর ছিল ৭৬ টাকা।

শাশা ডেনিমস গত বৃহস্পতিবার সমাপনী দরছিল ৭৭.৩০ টাকা। সর্বশেষ লেনদেন হয় ৭৬.৫০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দর ৩৫.১০ টাকা থেকে ৭৭.৩০ টাকার মধ্যে উঠানামা করে।

ডেরিন পাওয়ার গত বৃহস্পতিবার সমাপনী দরছিল১০৭.৩০ টাকা। সর্বশেষ লেনদেন হয় ১০৭.৮০ টাকা। এদিকে গত তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিন্ম দরছিল ৭৭.২০ টাকা, আর সর্বেবাচ ১৪১.৮০ টাকা। এত অল্প সময়ের মধ্যে অভিহিত দরের নিচে থাকা কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

ভিশন ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি কখনও বাজারের জন্য ভালো খবর নয়, বরং এসব শেয়ারের দর বৃদ্ধি পুঁজিবাজারে স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করে।

বিনিয়োগকারীরা না বুঝে অনেক সময় এসব শেয়ারের পেছনে ছুঁটেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর ফল শুভ হয় না। তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নরজদারি বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের সর্তক থাকতে হবে। তারা সতর্ক থাকলে পুঁজি নিরাপদে থাকবে।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে স্টার্লিং সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘কোনো বিশেষ খবর কিংবা গুজবে অনেক সময় এসব শেয়ারের দর বাড়তে দেখা যায়। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় এসব শেয়ারের দর বৃদ্ধির ধারা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের সব সময় খেয়াল রাখা দরকার।’

অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্চেন্ট ব্যাংক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা জানান, বাজারে অনেক ভালো শেয়ার থাকলেও বিনিয়োগকারীরা এখন স্বল্প সময়ে দ্রুত মুনাফা করার জন্য এসব শেয়ারের পিছে ছুঁটছেন। এটি বাজারের জন্য সুখের খবর নয়। ডিএসইর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজবী বলেন, ‘পুঁজিবাজার এখন ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে।

বিনিয়োগকারীরাও বাজারে ফিরে আসছেন; এটা ভালো খবর। তবে তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেন কোনো ধরনের ভুল না করেন।’ তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে এখন অনেক ভালো মৌলভিত্তির শেয়ার ক্রয়যোগ্য রয়েছে। দুর্বল কোম্পানির দিকে না ঝুঁকে তারা যদি এসব কোম্পানিতে দেখেশুনে বিনিয়োগ করতে পারেন, তাহলে তারা ভালো ফল আশা করতে পারবেন।’