share-bazarএইচ কে জনি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিপর্যয়ের ধারা কাটিয়ে অনেকটাই স্থিতিশীলতার পথে হাটছে দেশের পুঁজিবাজার। চলতি বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই ছোট খাটো কারেকশনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে দৈনিক লেনদেন, বাজার মূলধন ও সূচকের পরিমাণ বাড়ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও ফিরে আসতে শুরু করেছে।

বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে সরকারের সহযোগীতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষনে বিএসইসির একাধিক সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বাজারমুখী হচ্ছেন।

এছাড়া পুঁজিবাজারের স্টেক হোল্ডারদের সক্রিয়তাও পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে বর্তমানে এ স্থিতিশীলতা ধরে রাখাটাই পুঁজিবাজারের নীতি নির্ধারকদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষনে দেখা গেছে, গত  ১১ জুলাই বাজারে ২৭২ কোটি টাকায় লেনদেন হয়।

যা পরের দিনই বেড়ে ৩৯৪ কোটি টাকায় উঠে আসে। এরপর আর ২০০ কোটির ঘরে নামে নি পুঁজিবাজারের লেনদেন। বরং ছোটখাটো কারেকশনের মধ্য দিয়ে তা গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রায় ৭০০ কোটির কাছাকাছি চলে আসে। যদিও গতকাল বাজারে ৪০৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তবে এটাকে কারেকশন বলেই মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

এদিকে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকার ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তা-ব্যক্তিরা একযোগে কাজ করে আসছেন। দেশের পুঁজিবাজারকে আরো উন্নত স্তরে উন্নীত করতে দ্রততার সঙ্গে বেশ কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত নতুন নতুন প্রোডাক্ট চালু করা, ডিজিটালাইজড ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং পুঁজিবাজার সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি’ প্রোগ্রাম চালু করার উদ্যোগ অন্যতম।

এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি ২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে অস্থিতিশীল বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ চিন্তা করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিগত সময়ের ধারাবাহিক মন্দায় বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গাটা একেবারেই শুণ্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। যার ফলে গত কয়েকদিন যাবত বাজারে সূচক ও লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে।

স্থিতিশীলতার পথে হাটছে থমকে যাওয়া পুঁজিবাজার। তবে এ স্থিতিশীলতা ধরে রাখাটাই পুঁজিবাজারের নীতি নির্ধারকদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ বলে তারা মনে করছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ২০১০ সালের ধসের পর বাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে নি। মাঝে মধ্যে বাজারে স্থিতিশীলতার সুবাতাস বইলেও তার স্থায়ীত্ব ছিল না।

মুলত বাজারে কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম, উচ্চ প্রিমিয়ামে ঝুঁকিপূর্ন কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা, নীতি নির্ধারক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত, বিনিয়োগকারীদের অসচেতনতা, তদন্তের নামে কালক্ষেপন এবং বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকার কারণেই বাজার স্থিতিশীলতার শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে নি।

আর তাই পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলা যায় যে, বর্তমান বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিএসইসিকে এ বিষয়গুলোতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলেও মত দিয়েছেন তারা।

বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ধস পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোপরি সরকারের নানা উদ্যোগেও বাজারের সুদিন ফেরে নি। গত সাড়ে চার বছর ধরেই টাল-মাটালভাবে পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। মন্দাবাজারেও অনেকে দিব্যি ব্যবসা করছেন, তবে লোকসানের মুখে পড়ছেন অধিকাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী। এর মূল কারণ হচ্ছে- বাজার সর্ম্পকে স্বচ্ছ ধারণা না থাকা।

এটাই স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে অন্যতম এবং বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে বিনিয়োগকারীদের সচেতনা ও আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে তারা মনে করছেন। এছাড়া কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম, স্বল্পমূলধনী কোম্পানির আকাশচুম্বী শেয়ার দরের কারণ বিশ্লেষনে বিএসইসিকে বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে।

যেকোন অনিয়মের তদন্তেই কালক্ষেপন করলে চলবে না। কারণ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময়কাল থেকে তদন্তের রিপোর্ট আসা সময় পর্যন্ত বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কাজেই যতদ্রুত সম্ভব তদন্তের কার্যক্রম শেষ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তারা বলেন, অনেক সময় দেখা যায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পর অনিয়মের তুলনায় শাস্তির পরিমাণ খুবই কম হয়। অর্থাৎ ‘গুরু পাপে লঘু দন্ড’। যা অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। কারণ যে অপরাধ করে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, সে অপরাধে শাস্তি স্বরুপ লাখ টাকা জরিমানাকে ব্যবসায়ের কমিশন হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

কাজেই অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির মাপকাঠি নিরুপনও বাজার স্থিতিশীলতা বিবেচ্য বিষয়। তারা বলেন, বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা মোটামোটি বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের এই আস্থার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এক্ষেত্রে বিএসইসিকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

কারণ দীর্ঘ দরপতনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে তলানিতে চলে গিয়েছিল। বাজারকে তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনতে বাজারে যারা সক্রিয় ছিলেন, তারাও যেন দিক হারিয়ে ফেলছিলেন। বাজার যখনই একটু স্বাভাবিক অবস্থার দিকে যেতে শুরু করতো তখনই রাজনৈতিক অস্থিরতা, একশ্রেণীর অসাধু চক্রের ছড়ানো নানা গুজব বাজারের নেতিবাচক প্রবণতা আরো তরান্বিত করে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এদের কারসাজির কবলে ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়ে। পরিনতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা বারবার নড়বড়ে হয়ে যায় এবং তারা বাজারের প্রতি বারবার আস্থাহীন হয়ে পড়ে।

আর তাই অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিতকে আরো শক্তিশালী করতে বিএসইসিকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রসঙ্গে তারা বলেন, বাজারের গতিধারা দেখে মনে হয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা চালকের ভূমিকায় রয়েছে। কারণ তারা বিনিয়োগে আসলে বাজার উর্ধ্বমূখী আর নিষ্কৃয়তা বাজার নিম্নমূখী আচরণ করে। এটা বাজারের জন্য খুবই নেতিবাচক দিক।

এ অবস্থায় বাজারকে ধরে রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে বাজারে যাতে কোন ধরণের অনৈতিক কাজ ঘটতে না পারে সেজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করা প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির সমন্বয়হীন সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অবশ্য এ নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তা-ব্যক্তিদের মধ্যে বাক-বিতন্ডাও হয়েছে।

তবে বাজারের স্থিতিশীলতার ধারা অব্যাহত রাখতে নীতি-নির্ধারণী মহলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তারা। কারণ আর্থিক খাত ও বাজারের উন্নয়নের জন্যই এ দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তা-ব্যক্তিদের নীতি-নির্ধারনীর আসনে বসানো হয়েছে। কিন্তু তাদের খাম-খেয়ালিপনা ও স্বেচ্ছাচারীতার কারণে বাজার ও আর্থিক খাত তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বেÑ তা কখনোই মেনে নেয়া যায় না।

এক্ষেত্রে এসব নীতি-নির্ধারণী মহলের কর্তা-ব্যক্তিদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে বাজার বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীরা সরকারের উচ্চ মহলের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে সমন্বয়হীনতা দূর করতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য খাতগুলোর নীতি নির্ধারণী মহল ও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে বিএসইসিকে মাসে অন্তত একবার বৈঠক করা জরুরী বলে তারা মনে করছেন।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ না। তবে এক্ষেত্রে বাজারকে অস্থিতিশীল করে এমন বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে তার ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি বলেন, কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম বন্ধে বিএসইসিকে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে।

বিভিন্ন অনিয়মের শাস্তি প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনিয়মের আকার বিবেচনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আবার কিছু কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু নামমাত্র জরিমানা করলেই চলবে না। প্রয়োজনে অপরাধী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরো কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই দেশে কোন ড্রাইভার আইন ভঙ্গ করলে তাকে শুধু জরিমানাই করা হয় না, বরং তার লাইসেন্সে একটি ফুটো করে দেওয়া হয়। এভাবে তিনবার ফুটো করলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অনিয়মের মাত্রা কমে আসে।

বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, বর্তমান বাজার যথেষ্ট স্থিতিশীল রয়েছে। এমতাবস্থায় অধিক মুনাফা লাভের জন্য পুজিবাজারই বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুজবে কান না দিয়ে জেনে, শুনে ও বুঝে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি।