takaশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশি নাগরিকদের জমানো টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শুধু এক বছরে তা বেড়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ৮ লাখ সুইস ফ্রাঁ। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্রাঁ ৮৮ টাকা হিসাবে)। সুইস ব্যাংকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্র্যাংক।

স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এক বছরে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১০ শতাংশ। বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা পাচার এবং বিদেশে কর্মরত অনেক বাংলাদেশি নাগরিক সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রাখায় সেখানে বাংলাদেশিদের জমা টাকার পরিমাণ বেড়েছে।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের টাকা বাড়লেও ভারতীয়দের গচ্ছিত টাকার অংকের রেকর্ড পতন ঘটেছে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে  দাড়িয়েছে ১.২ বিলয়ন ফ্রাঁ যা ভারতীয় টাকায় ৮ হাজার ৩৯২ কোটি রুপি। সম্পতি ভারতে টাকা পাচারে কড়াকড়ির কারণে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থ ৫৯৬.৪২ মিলিয়ন ফ্রাঁ কমে ১২১৭.৬ মিলিয়ন ফ্রাঁ হয়েছে । ১৯৯৭ সালে পর থেকে এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে এটি সর্বনিম্ন অংক।

প্রসঙ্গত ২০০৬ সালে এই অংকটি সর্বোচ্চ হয়েছিল। সেবার সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থ দাঁড়িয়েছিল ৬.৫ বিলিয়ন ফ্রাঁ (২৩,০০০কোটি টাকা)। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। পাচার করা টাকার একটি অংশ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা হচ্ছে।

 

অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি হিসাবে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। এর বাইরে গত দুই অর্থবছরে সুইস ব্যাংকগুলো বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে।

 

এ প্রসঙ্গে সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে বিদেশে অর্থ পাচার বেড়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে।

দেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৬৬ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে। ওই বছরে ১০০টি দেশের মধ্যে পাচারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অবস্থান ৪০ তম।

 

বাংলাদেশিদের আমানত:

 

গত ১৩ বছরের মধ্যে ২০১৫ সালেই বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি আমানত রেখেছে সুইস ব্যাংকে। আলোচ্য সময়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ বেড়ে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ফ্রাঁ হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।

২০১৩ সালে ছিল ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্রাঁ। এগুলো শুধু নগদ অর্থের হিসাব। ব্যাংকের ভল্টে স্বর্ণালংকার, শিল্পকর্ম বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্য আমানতের এই হিসাবের সঙ্গে যোগ হয়নি। সেগুলোর হিসাব রয়েছে আলাদা।

 

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই। এর ফলে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে।

 

সূত্র জানায়, সুদীর্ঘ সময় ধরে ধনীদের অর্থ গোপনে জমা রাখার জন্য বিখ্যাত সুইজারল্যান্ড। ৮০ লাখ মানুষের এ দেশটিতে ব্যাংক আছে ২৮৩টি। বিশ্বের বড় বড় ধনীরা অর্থ পাচার করে দেশটির বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে জমা রাখে। ব্যাংকগুলোও কঠোর গোপনীয়তায় তা রক্ষা করে। আগে সুইস ব্যাংকে জমা টাকার কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। এমনকি আমানতকারীর নাম-ঠিকানাও গোপন রাখা হতো। একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে টাকা জমা রাখা হতো।

কিন্তু বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর করায় আন্তর্জাতিক চাপে সুইস ব্যাংক জমা টাকার তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে তারা ওই সময় থেকে বিভিন্ন দেশের জমা টাকার তথ্য প্রকাশ করছে। ওই প্রতিবেদনে কোন দেশের কত টাকা জমা আছে, সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। তবে আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। ফলে পাচারকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে না। পাচারকারীরা পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

এদিকে গত বছর সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এটি সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোচিত হয়। বাংলাদেশেও এটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ব্যাংকে চিঠি দিয়ে কারা টাকা জমা রেখেছে তাদের তালিকা চেয়েছিল। কিন্তু এখনও এ ব্যাপারে সুইস ব্যাংক কোনও সাড়া দেয়নি।

কোন বছর কত: সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক দশকের মধ্যে ২০১৩ সালেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি অর্থ গচ্ছিত ছিল। এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত ছিল ২০০৭ সালে। সে বছর সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা দুই হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অবশ্য এ বছরই সুইস ব্যাংকসমূহের বৈশ্বিক গ্রাহকেরা সর্বোচ্চ দুই লাখ ৬০ হাজার কোটি সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ২১৭ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রেখেছিলেন।

২০০৮ সালে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ নেমে আসে ১০ কোটি ৭০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮৯২ কোটি টাকায়। ২০০৯ সালে এটি কিছুটা বেড়ে হয় ১৪ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা এক হাজার ২৪১ কোটি টাকা। ২০১০ সালে তা আরও বেড়ে হয় ২৩ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা এক হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। তবে ২০১১ সালে তা বেশ কমে হয় ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা এক হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।