kor fakiশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: আমাদের বিদেশী বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করা। সেটি হয়নি। উল্টো টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশী বিনিয়োগ আমাদের প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান কিংবা দক্ষতা বৃদ্ধিতে কতটা কাজে আসছে? এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে’। বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছে।

১৮টি দ্বি-পাক্ষিক ‘অপচুক্তি’র মাধ্যমে বিশ্বের ১৫টি দেশের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে এ টাকা নিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে শনিবার (২৮ মে) একশন এইড আয়োজিত ‘দুর্বিনীত কর-আঘাত, অসমর্থিত বাজেট’ বিষয়ক আলোচনা সভায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কর্পোরেট ট্যাক্স এর মত প্রত্যক্ষ কর আদায়ে আমরা খুব বেশি চতুর ও দক্ষ হতে পারিনি। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে আমাদের সুযোগ দিতে হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের যতটা কঠোর ও কৌশলি হওয়া উচিৎ ছিল সেটা আমরা হতে পারিনি।’

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘জাতিসংঘের বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার যে নীতিমালা আছে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, সেটি যদি আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে ফাঁকির পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে। একটি আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে করতে হবে।

সেটি না হলে অন্য দেশ সুযোগ বেশি দিয়ে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে যাবে। তাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থাকলে এবং সবাই সেটি মানলে আমরা কর আদায় বেশি করতে পারবো’।

সভায় একশন এইড’র পক্ষ থেকে ‘অপচু্ক্তি’ নামের একটি প্রতিবেদনের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মূলত রাজনৈতিক ও সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মত নিয়ন্ত্রণমূলক ‘অপচুক্তি’ করিয়ে এই আর্থিক সুবিধা নিচ্ছে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পুনারায় বিনিয়োগের কথা থাকলেও কর্পোরেটরা লাভকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এদেশ থেকে মুনাফা নেওয়ার পাশাপাশি ফাকিঁ দেওয়া করের টাকাও নিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

অনুষ্ঠানে ‘অপচুক্তি’ নামের গবেষণাটি তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের ডিরেক্টর আজগর আলী সাবরি। গবেষণার ফলফলে বাংলাদেশে বাজেট, উন্নয়ন ও নীতিতে কি প্রভাব ফেলছে সেটি তুলে ধরা হয়। গবেষণাটিতে ৫০০ বেশি আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ নিয়ে সমীক্ষা করা হয়। যেখানে দেখা যায়, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৮টি অপচুক্তি আছে এবং বেশি কর ফাঁকি হচ্ছে।

এই চুক্তিগুলোর একটি ধারার কারণে বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের টাকার উপর করের লভ্যাংশ নিতেও বাংলাদেশের ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। কর ফাঁকির এই টাকা দিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩৪ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যেত, বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতার অভাবে কর্পোরেটরা বেশি সুযোগ নিচ্ছে। আমরা বলছি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সেটা করতে গিয়ে আমরা যদি তাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেই, সেটা যৌক্তিক না। আমাদের গরীব মানুষের সুবিধা বাড়াতে হবে কর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে’।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আশির দশকে আমাদের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার ছিল। তাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে আনতে হয়েছে। সেই সুযোগে তারা তাদের মত করে চুক্তি করেছে এদেশের নীতিনির্ধারকদের দিয়ে। আমাদের দেশে কর ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এটা হতে পারে না।’

‘একটি বড় টেলিফোন প্রতিষ্ঠান মাত্র ৪৫০ জন লোক নিয়ে কাজ করছে। তারা আমাদের মানুষের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। আমি যদি জামাই আদর না করি তবে সে আসবে না, এটা ভাবার সময় এখন আর নেই। এখন চুক্তিগুলো পূর্ণমূলায়ণ বা বাতিল করা উচিৎ, বলেন আব্দুল মজিদ।

বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার ড. স্বপন কুমার বালা বলেন, ‘যে দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, সে দেশে যদি আমাদের বিনিয়োগ করা যেত তবে আমরা চুক্তির আলোকে কথা বলতে পারতাম। চুক্তি থেকে কিভাবে সুবিধা নিতে হবে সে বিষয়ে সচেতনতা দরকার। আমরা অনেক ক্ষেত্রে সচেতন ছিলাম না’।

বাংলাদেশ বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট’র প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ‘আমাদের বিদেশী বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করা। সেটি হয়নি। উল্টো টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশী বিনিয়োগ আমাদের প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান কিংবা দক্ষতা বৃদ্ধিতে কতটা কাজে আসছে? এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে’।

অনুষ্ঠানে কর্পোরেট ট্যাক্স ফাঁকি কামাতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। যেখানে বলা হয়, সমস্ত দেশ মিলে একটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে, যাতে কেউ সুযোগ না নিতে পারে। দেশীয় পর্যায়ে চুক্তিগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে সরকারসহ সব পর্যায়ে।