dse-cse lagoশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আস্থা সংকট থাকায় বাজারে বিনিয়োগমুখী হতে পারছে না। এছাড়া বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করার পরিবেশও এখনো সৃষ্টি হয়েনি বলে মনে করছেন একাধিক বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আচরন বাজারের জন্য ইতিবাচক নয় বলে মনে করছেন।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন কাজ করছেন না বরং তিনি তার ব্যক্তি স্বার্থ কাজ করছেন এমন অভিযোগ করেন বিনিয়োগকারীরা। আর এসব কারনে নতুন করে বিনিয়োগ তৈরি হচ্ছে না। তাই পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে হলে নতুন করে বিনিয়াগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

dse-grapদেশের দুই পুঁজিবাজারে একদিকে রয়েছে তারল্যের সঙ্কট অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। বাজার উন্নয়নে সকারের নেওয়া নানা উদ্যোগও কাজে আসছে না। ফলে দীর্ঘ দিন পুঁজিবাজারে চলছে অস্থিরতা। আর বর্তমান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট ও তারল্য সংকটের কারনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না।

বর্তমান বাজার নিয়ে সরকারসহ নীতি নির্ধারকরা বাজার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। তবে গত চার কার্যদিবস ধরে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে বাজার আগাতে শুরু করলেও লেনদেন বাড়ছে না। সুচকের সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনের গতি বাড়তে থাকলে বাজার দ্রুত এগাতো বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বিনিয়োগ করতে পারছে না পুঁজিবাজারে। ফলে অর্থ সঙ্কটে ভুগছে পুঁজিবাজারর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তার কারনে ১০টি ব্যাংক এক্সপোজার সমন্বয়ের পর বিনিয়োগের জন্য বাড়তি যে সুযোগ পাচ্ছে সেই যদি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তাহলে দ্রুত পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবো।

গত কয়েক দিনের বাজার মূলধনের তুলনায় পুঁজিবাজারে বর্তমান দৈনিক লেনদেন খুবই নগন্য পরিমাণ। এক কথায় দৈনিক লেনদেনে তীব্র ভাটা চলছে। এমতাবস্থায় বাজারকে ঘিরে আস্থা সংকটে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে সার্বিক পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাই বাজারকে স্থিতিশীল করতে নীতিনির্ধারণী মহলের যুগপোযোগী পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।

জানা যায়, লেনদেন কমার কারণে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিরতার বৃত্তে আটকে যাচ্ছে। একসময়ের হাজার কোটি টাকার দৈনিক লেনদেন এসে ঠেকেছে তিনশো কোটির ঘরে। এতে নতুন বিনিয়োগে নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি মূলত ৩ ইস্যুকে ঘিরে পুঁজিবাজারে লেনদেন ভাটা পড়েছে।

জানা গেছে, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী, সিকিউরিটিজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মার্জিন লোনে আটকে যাওয়া,যে দরে শেয়ার কেনা হয়েছে বর্তমানে তার অর্ধেকে নেমে আসা,সেকেন্ডারির বেহাল দশায় প্রাইমারি মার্কেটে (আইপিও) আগ্রহ বেশি থাকায় লেনদেন এতো কম হচ্ছে। ডিএসইর বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ৭৪৩ কোটি টাকা (১৩ মার্চ ২০১৬) এবং সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে ২৫৮ কোটি টাকা ( ১৫ মে ২০১৬)।

এদিকে গত বছরের ১ জুন সর্বশেষ হাজার কোটি টাকায় লেনদেন হয়। এদিনে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ০০২ কোটি ৩৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা। তারপর থেকে এ পর্যন্ত একদিনও দৈনিক লেনদেন হাজার কোটির ঘরে পৌছায়নি। চলতি বছরের বেশিরভাগ কার্যদিবসে দৈনিক লেনদেন ৩০০ থেকে ৪০০ কোটির ঘরে অবস্থান করেছে। ফলে বর্তমান বাজারের পিই রেশিও অনুযায়ী বিনিয়োগ উপযোগী হলেও আস্থা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। আর এর নেপথ্যে উল্লেখিত বিষয়গুলো প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের অধিকাংশ সিকিউরিটিজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা মার্জিন ঋণ দিয়েছে। এর অর্ধেক সরবরাহ করা হয়েছে সিকিউরিটিজ হাউজ এবং বাকি অর্ধেক দিয়েছে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

এসব ঋণের সিংহভাগই নিয়েছেন মাত্র কয়েক হাজার গ্রাহক। এক্ষেত্রে মোট মার্জিন ঋণের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৫০০ গ্রাহক। এদের মধ্যে ৩০ থেকে ৫০ গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ ৩০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকা। এদিকে বিগত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারে ক্রান্তিকাল থাকায় অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মার্জিন লোন পরিশোধ করেনি। ফলে চক্রবৃদ্ধিহারে প্রতিনিয়তই ঋণের সুদ লোনের সঙ্গে যোগ হয়ে সুদ-আসল প্রায় সমান হয়ে গেছে।

অপর দিকে মার্জিন লোন আদায় করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এক্ষেত্রে নতুন করে ঋণ দেয়া হাউজগুলোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট বাড়ার পাশাপাশি লেনদেন কমে যাচ্ছে।

এদিকে দীর্ঘ লোকসানে শেয়ার নিয়ে বসে থাকা,নিটিংয়ে ঝুঁকে নগদ টাকা আটকে যাওয়া,অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর নতুন করে বিনিয়োগের জন্য তারল্য সংকট থাকা লেনদেন কমার আরেকটি অন্যতম কারণ।

অন্যদিকে সেকেন্ডারি মার্কেটের এরকম বেহাল দশায় বিনিয়োগকারীরা প্রাইমারি মার্কেটের দিকে ঝুঁকছে। যেখানে আগে বাজারে বিরুপ প্রভাব থাকলে একাধিক কোম্পানির আইপিওতে আন্ডারসাবস্ক্রাইব হতো: সেখানে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি আগের তুলনায় খারাপ থাকা সত্ত্বেও ওভার সাবস্ক্রাইব হচ্ছে।

এমনকি বর্তমানে মাত্রাতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিও আবেদন করার পরও ওভার সাবস্ক্রাইব হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি আইপিও প্রক্রিয়া শেষ করা প্রতিটি কোম্পানির ক্ষেত্রে কয়েকগুন আবেদন জমা পড়েছে।

বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা করছে, সেকেন্ডারি থেকে প্রাইমারিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত। কারণ এসব কোম্পানির লেনদেন শুরুর ক্ষেত্রে আর যাই হোক লোকসান হয় না। বিনিয়োগকারীদের এমন ধারণায় প্রাইমারি মার্কেট চাঙ্গা হলেও সেকেন্ডারি মার্কেট বিপত্তির মধ্যে পড়ছে।

এ ব্যাপারে বাজার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, মার্জিন লোনের যাতাকলে আসলে বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও ফেঁসে গেছে। এক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে রয়েছে। যেগুলো কাজে লাগালে বাজারে তারল্য সংকট কেটে যেতো। বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে আইপিওর দিকে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। তবুও বাজারে ভালো কোম্পানি আসলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের মার্কেট সার্পোটের কারণে বাজারে সূচক বাড়ছে। তবে সাধারণ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা না ফেরায় এখনো পুঁজিবাজারে লেনদেনের সংকট বিরাজ করছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজিব উদ্দিন আহমেদ বলেন, মার্কেটের প্রতি কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না। বিনিয়োগকারীরা চাইছেন হাতে থাকা শেয়ার ভালো দামে বিক্রি করে দিতে। কিন্তু নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছেন না। তাই লেনদেন বাড়ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন নতুন ফান্ড। বাজারে নতুন করে যতো ফান্ড আসবে বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আস্থা ততো বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মনে করেন, মন্দা বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় আইপিওতে (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) অনেক বেশি কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যার বেশিরভাগ আবার দূর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি। ফলে সেকেন্ডারি মার্কেটে এসব কোম্পানি আসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই নতুন করে বিনিয়োগ করতে কেউ সাহস পাচ্ছেন না।